বিশ্ব বই দিবসে টুকরো কিছু গল্প মনে পড়ছে

আমি নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরের একটি আবাসিক এলাকায় থাকি, যেখানে মূল শহর থেকে বাসে যেতে সময় লাগে ১৫ মিনিট। এক দিন বাস স্ট্যান্ড থেকে হেঁটে বাসায় ফিরছি, চোখ আটকে গেল একটি বাসার সামনের দু’পাশের গেটের দেয়ালে রাখা বইয়ের স্তূপে। সঙ্গে সঙ্গে ছবি তুললাম এবং প্রতিবারের মতো বাসায় এসে যথারীতি আমার ল্যান্ডলেডীকে কারণ জিজ্ঞাসা করলাম। সে বলল এখানে বইয়ের দাম অনেক, সুতারাং আমার কাছে কোনো ভালো বই থাকলে আমি চাই অন্যরা পড়ুক। আমি বললাম ওখানে বই পরার তো কোনো জায়গা নেই, তাহলে কি রাস্তায় বসে বই পড়ব? উনি বললেন তুমি যদি চাও নিজের বাসায় এনে পরতে পারো তাতে কোনো সমস্যা নেই এবং পড়া শেষ করে আবার সেখানে রেখে আসবে। আমি ভাবতে লাগলাম কোন সমাজ এত সহজ আর সুন্দর হতে পারে। হ্যাঁ হতে পারে।
আর একটি গল্প হলো—নেদারল্যান্ডসের ডেলফত শহরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি রাস্তার দু’পাশে সারি বাঁধানো গাছের চারদিকে বইয়ের লাইব্রেরি করা হয়েছে এবং সেখানে বসার ব্যবস্থাও করা আছে।বই পরার জন্য আপনাকে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হতে হবে না। আপনি হতে পারেন পথচারী, পর্যটক তাতে কোনও সমস্যা নেই। আপনি বই পড়ে আবার একই জায়গায় বইটা রেখে নিজ গন্তব্যে চলে যাবেন।

অন্যদিকে ৬৪ জেলা ভ্রমণের সময়, দেখেছি আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত দেশ জুড়ে পুরোনো গণগ্রন্থাগারগুলোর বর্তমান হাল। বিশেষ করে মনে পড়ছে নোয়াখালি পাবলিক লাইব্রেবির কথা। ২০১৯ সালের কথা বলছি, লাইব্রেবির ভেতরে প্রবেশ করতে পারিনি। চাবি কার কাছে কেউ জানে না। দীর্ঘ সময় বন্ধ পড়ে আছে। ভেতরে বই নেই। লাইব্রেবির একপাশ দিয়ে বৃষ্টির সময় পানি পরে বলে স্থানীয়জনরা জানিয়েছিল।
বছর খানেক আগে কুমিল্লা থেকে ফোনে আমার কিছু শুভাকাঙ্খী জানিয়েছিলেন টাউন হলের বীরচন্দ্র পাঠাগার ভেঙে মার্কেট করা হবে। ২০১৯ সালে বীরচন্দ্র পাঠাগারের ভেতরে যাবার সুযোগ হয়েছিল। ঐতিহ্যের কিছুটা ছোঁয়া রয়েছে । বইয়ের সংখ্যা সেখানে নেহায়েত কম ছিল না। বর্তমানে কেমন আছে পাঠাগারটি জানি না।
বছর খানেক আগে কুমিল্লা থেকে ফোনে আমার কিছু শুভাকাঙ্খী জানিয়েছিলেন টাউন হলের বীরচন্দ্র পাঠাগার ভেঙে মার্কেট করা হবে। ২০১৯ সালে বীরচন্দ্র পাঠাগারের ভেতরে যাবার সুযোগ হয়েছিল। ঐতিহ্যের কিছুটা ছোঁয়া রয়েছে । বইয়ের সংখ্যা সেখানে নেহায়েত কম ছিল না। বর্তমানে কেমন আছে পাঠাগারটি জানি না।
এতসব মনকষ্টের মাঝেও দেশ জুড়ে টিকে থাকা পাঠাগারের মাঝে যশোরের পাবলিক লাইব্রেরি দেখে ভালো লেগেছিল । প্রায় ১৬৮ বছরের পুরনো একটি ঐতিহাসিক গণগ্রন্থাগার। ১৮৫৪ সালে শহরের প্রাণকেন্দ্রে ৩ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। যশোরের তৎকালীন জেলা কালেক্টর আর.সি রেকস এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি এই লাইব্রেরির ভবন নির্মাণ এবং পুস্তক সংগ্রহের কাজে সেকালের বিত্তবান শ্রেণির কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য সংগ্রহ করেছিলেন। কয়েকজন সুহূদ নীলকর সাহেব এবং নলডাঙ্গা ও নড়াইলের জমিদার এই লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠায় রেকসকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। সে সময়ে এই প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল যশোর পাবলিক লাইব্রেরি। ১৮৫৪ সালেই লাইব্রেরির নিজস্ব ভবন নির্মিত হয়।
যে কোনো দেশ ভ্রমণে গেলেই বুকশপ , লাইব্রেরিগুলো দেখলেই কেন যেন নিজের দেশের সঙ্গে তুলনার বিষয়টি আপনা আপনি চলে আসে। পৃথিবী অপার সম্ভবনার জায়গা, তাই আশা করতেই পারি আমাদের সমাজও এমন সহজ এবং সুন্দর হবে।

আজ বিশ্ব বই দিবস। রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্যোগে ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতিবছর এই দিবসটি পালন করা হয়। বই দিবসের মূল উদ্দেশ্য হলো, বই পড়া, বই ছাপানো, বইয়ের কপিরাইট সংরক্ষণ করা ইত্যাদি বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানো।
বিশ্ব বই দিবসের মূল ধারণাটি আসে স্পেনের লেখক ভিসেন্ত ক্লাভেল আন্দ্রেসের কাছ থেকে। ১৬১৬ সালের ২৩ এপ্রিল মারা যান স্পেনের এক বিখ্যাত লেখক মিগেল দে থের্ভান্তেস। আন্দ্রেস ছিলেন তার ভাবশিষ্য। নিজের প্রিয় লেখককে স্মরণীয় করে রাখতেই ১৯২৩ সালের ২৩ এপ্রিল থেকে আন্দ্রেস স্পেনে পালন করা শুরু করেন বিশ্ব বই দিবস।
বিশ্ব বই দিবসের মূল ধারণাটি আসে স্পেনের লেখক ভিসেন্ত ক্লাভেল আন্দ্রেসের কাছ থেকে। ১৬১৬ সালের ২৩ এপ্রিল মারা যান স্পেনের এক বিখ্যাত লেখক মিগেল দে থের্ভান্তেস। আন্দ্রেস ছিলেন তার ভাবশিষ্য। নিজের প্রিয় লেখককে স্মরণীয় করে রাখতেই ১৯২৩ সালের ২৩ এপ্রিল থেকে আন্দ্রেস স্পেনে পালন করা শুরু করেন বিশ্ব বই দিবস। এরপর দাবি ওঠে প্রতিবছরই দিবসটি পালন করার। অবশ্য সে দাবি তখন নজরে আসেনি কারোরই। বহুদিন অপেক্ষা করতে হয় দিনটি বাস্তবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য। অবশেষে ১৯৯৫ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ দিনটিকে বিশ্ব বই দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং পালন করতে শুরু করে। এরপর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিবছর ২৩ এপ্রিল বিশ্ব বই দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। উল্লেখ্য, ২৩ এপ্রিল শুধুমাত্র বিশ্ব বই দিবসই নয়, শেক্সপিয়র, সত্যজিৎ রায়, ইনকা গার্সিলাসো ডে লা ভেগাসহ প্রমুখ খ্যাতিমান সাহিত্যিকদের জন্ম ও প্রয়াণ দিবসও। আর এ কারণেও ২৩ এপ্রিলকে বিশ্ব বই দিবস হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন অনেকেই।
লেখক: এলিজা বিনতে এলাহী, ঐতিহ্য পর্যটক