‘একুশে ফেব্রুয়ারী’–দুপুরের নৈঃশব্দ্য খুন

জহির রায়হান নিজে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের মিছিলে প্রথম দশজনের একজন ছিলেন। সে বিচারে ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’, ‘আরেক ফাল্গুন’, ‘একুশের গল্প’ তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ডায়েরির অংশ হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। ডায়েরি আত্মজীবনীরূপে সাহিত্যের অংশ হতে পারে। কিন্তু আত্মজীবনীর বাইরে কথাসাহিত্যের যে বিস্তৃত শাখাপ্রশাখা, সেখানে লেখকের মুনশিয়ানা দেখানোর এন্তার সুযোগ। সেখানেই সফল জহির রায়হান। হাতের কাছে যা আছে, তাই নিয়ে ছবি বানাব—এরকম জেদ, পরাধীনতার নাগপাশে থেকে, মনে ধরে কাজ করার এবং সফল হওয়ার উদাহরণ একজনই—জহির রায়হান। আমি ‘আরেক ফাল্গুন’ বিশ্লেষণ করবার সময় খেয়াল করেছি, লিখেছিও—চালচ্চিত্রিক পরিচর্যা জহির রায়হানের লেখনীতে স্পষ্ট। ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’তে আরো স্পষ্ট এ পরিচর্যা। মনে হয়েছে পুরো পঁচিশটা পৃষ্ঠাই একটা প্রাণবন্ত সিনেমা।
প্রাথমিকভাবে অবশ্য প্রতীকায়িত পরিচর্যার আশ্রয়ে এতদাঞ্চলের মানুষের ওপর পাকিস্তানি শাসকদের আরোপিত দুঃশাসনের নমুনা তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক।
জহির রায়হান লিখেছেন—
“…অনেকগুলো পাখি গাছের ডালে বসে নিজেদের ভাষায় অবিরাম কথা বলে চলেছে।…সহসা কতগুলো মুখ। শাসনের-শোষণের ক্ষমতার-বর্বরতার মুখ।…বন্দুকের আর রাইফেলের নলগুলো রোদে চিকচিক করে উঠলো।…প্রচণ্ড শব্দ হলো চারদিকে।
গুলির শব্দ।…
পাখিরা নীরব হলো…”
মনে পড়ে যায় তৌকির আহমেদের সিনেমা ‘ফাগুন হাওয়ায়’। পাখিকে প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করাটা সিনেমায় দেখেছি।
এ অংশের পরে রয়েছে অভিনব ধরণের চরিত্র পরিচিতি। চরিত্রায়ণে জহির রায়হানের নিজস্ব চরিত্রনাম ছাড়া শরৎসাহিত্যের প্রভাবও দেখেছি। অবশ্য ‘আমেনা’ তাঁর ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসেও প্রাসঙ্গিক।
‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ উপন্যাসে আমেনার বিপরীতে গফুর চরিত্রনাম দেওয়াটাকে শরৎসাহিত্যের সাথে মেলানোর কিছু নেই সে অর্থে। তবু মিল খুঁজি কী দেখে?
শরতের গল্প ‘মহেশ’–এর গফুর-আমেনা চরিত্রদুটো পিতা-কন্যা এবং নিম্নবর্গের প্রতিভু। ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’র গফুর-আমেনাকেও হালিক কৈবর্তের ভাগে ফেলা যায়। দেখা যাচ্ছে গফুর পুঁথি পাঠক। আমার মনে পড়ে সুরত আলীর কথা। আর তার সুরেলা পুঁথি—
“শুন শুন বন্ধুগণরে, শুন দিয়া মন।
ভেলুয়ার কথা কিছু শুন সর্বজন।।
কি কহিব ভেলুয়ার রূপের বাখান।
দেখিতে সুন্দর অতিরে রসিকের পরাণ।।
আকাশের চন্দ্র যেন রে ভেলুয়া সুন্দরী।
দূরে থাকি লাগে যেন ইন্দ্রকূলের পরী।।”
এ প্রসঙ্গে বিয়ের ফর্দ, রসভরা কলসি, ঘরবাঁধার স্বপ্ন—এসব অভিব্যক্তি জহির রায়হানেরই লেখায় এসেছে আরো (‘হাজার বছর ধরে’)। পল্লীকবির ‘বোবা কাহিনী’ উপন্যাসে আজাহের চরিত্রে বিয়েপাগলা যুবকের ব্যক্তিত্ব মনে পড়ে। মনে পড়ে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সে উপন্যাসে কীভাবে এসেছে, সে ফিরিস্তি।
বুড়িগঙ্গার ওপর দিয়ে খেয়া পেরিয়ে শহরে আসা এসব নিম্ন আয়ের জনগণকে কথাসাহিত্যে নিয়ে আসা প্রসঙ্গে পল্লীকবিকে তাগাদা দিয়েছিলেন তাঁরই বন্ধু কুদরতউল্লাহ্ সাহাব। একথা কবির স্মৃতিকথা ‘যাঁদের দেখেছি’ থেকে বললাম।
পুলিশের লোক আহমদ হোসেনের ছেলে তসলিম ছাত্ররাজনীতিতে জড়িত। জন অস্টিনের হার্ড পজিটিভিজম তথা ডান্ডার পিটুনির সূত্র যে ছাত্রসমাজ মানে না, তা প্রতিষ্ঠিত বাপছেলের পুলিশ-ছাত্র রসায়নে। প্রসঙ্গত মা চরিত্রের যে আবেগী রূপ তা অল্প এসেছে পরিচিতি অংশে। তসলিমদের নিষ্ঠুর হৃদয়ের ক্ষত হয়ে দূরত্ব বজায় রাখে সালমারা।
তসলিম চরিত্রের বিবর্ধিত রূপ ‘আরেক ফাল্গুন’–এর মুনিম।
কেরানি আনোয়ার হোসেন কবি চরিত্র। ‘আরেক ফাল্গুন’–এর রসুল তার মধ্যে প্রতিফলিত। রসুলের আমরা কোনো সংসার দেখিনি। এদিকে আনোয়ার-সালেহার সংসার জীবনে দুঃখ-অভাব আর অশান্তির আয়োজন।
মকবুল আহমদের আবার অভাব নেই। অথচ শান্তির অভাব তাকেও কুড়ে খায়। শ্রমিক-ছাত্রদের দাবি মানতে গেলে তার প্রতিপত্তি থাকে না। দাম্পত্য জীবন অসংলগ্ন। স্ত্রীর সাথে দূরত্ব। মডার্ন কালচার ডলিদের মতো মিসেস মকবুলও রক্ষা করে চলেন।
একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সেলিম। দেশ নিয়ে ভাবনা নেই। ভাবনা নেই ভাষা নিয়ে। উর্দু ভাষা সে জানে, ছেলেকেও তাই শেখায় বাংলার পাশাপাশি। স্ত্রীটি তার মুন্সিগঞ্জের বাঙালি। তাই উর্দু-বাংলা দুটোই তার দাবি। কিন্তু ছাত্রদের আন্দোলন তার রুটিরুজির পথে বাধা।
পরিস্থিতি যত উত্তাল হয়, আমেনার কপালে চিন্তার ভাঁজ সংখ্যায় বাড়ে, সালমার চোখে জল ছলছল করে।
মায়ের উৎকণ্ঠা বাড়ে, সালেহার অস্তিত্বের ভাবনা মাথাচাড়া দেয়। মকবুল স্ত্রীকে সাবধান করে, নগরীর ছাত্রপাড়ায় ঢল নামে। নামে সেলিম তার সম্বল রিকশাটির প্যাডেলে পা রেখে।
হঠাৎ ঢাকা মেডিকেলের সামনের রাস্তায় সমবেত কণ্ঠে ওরা–’রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’
ভেঙে যায় একশ চুয়াল্লিশ!
তারপর—
টিয়ারগ্যাস!
গুলি!
কাঁদানেগ্যাসে আর কতটা কান্না লেখা থাকে? আমেনার কান্নার কাছে সব ম্লান।
একটা লাশের কাছে পড়ে থাকা পুঁটলিতে দুটো শাড়ি, কিছু চুড়ি, আর একটা আলতার শিশি পাওয়া যায়।
আমেনা, সালেহা, মকবুল, সালমাদের সাথে আগেও পরিচয় ছিল। সেই পঞ্চাশ-ষাটের দশকের লোকগুলো বেঁচে থাকলে আজ কোথায়, জানতে ইচ্ছে করে মাঝে মাঝেই। যদি সুযোগ থাকত প্রশ্নটা করতাম সরাসরি জহির রায়হানকে।
রেজওয়ান আহমেদ, শিক্ষার্থী,বাংলা ভাষা ও সাহিত্য (৬ষ্ঠ আবর্তন),বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।