ড. সুনীল কান্তি দের কলিকাতা কেন্দ্রিক নবজাগরণ ও বাঙালি মুসলমান

পাঠ্যবইয়ে একটা জিনিস প্রায়ই চোখে পড়তো ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’। তোতাপাখির মতো মুখস্তও করেছিলাম। কিন্তু এর প্রকৃত স্বরূপ কি তার একটা স্পষ্ট ধারণা পেয়েছি ড. সুনীল কান্তি দে ‘র এই বইয়ে। বর্তমানে ধর্মীয় বর্বরতার যুগে বইটি একটি শিক্ষামূলক দর্শন এবং মাইলফলক। ঠিক একশো বছর আগে শুরু এই বাংলায় শুরু হয়েছিল একটা ধর্মীয় আলোড়ন। ইসলাম ধর্মের সংস্কার। ঠিক সংস্কার নয় ইসলামকে যারা ভুলভাবে বিশ্লেষণ এবং উপস্থাপন করে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন। কাজী মোতাহার হোসেন চৌধুরী লিখেছিলেন— ‘লোকহিতই ধর্মের উদ্দেশ্য, ধর্মকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করিতে গিয়া যদি দেখা যায় অকল্যাণ হচ্ছে, তবে বুঝতে হবে কোথাও একটা গোলমাল আছে।…আমরা ইসলামের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিতে চাই না-আমরা চাই বর্তমান মুসলমান সমাজের বদ্ধ কুসংস্কার এবং বহুকাল সঞ্চিত আবর্জনা দূর করতে।’একশো বছর আগের কথা সমসাময়িক সময়ে কতটা মূল্য রাখে তা সচেতন মানুষ মাত্রই বুঝতে পারবে।
তারপরের প্রবন্ধটি নজরুলের জাতীয় সংবর্ধনার(১৯২৯) চিঠিপত্র নিয়ে একটি পর্যালোচনা। সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন এবং তৎকালীন প্রগতিশীলেরা তৎকালীন সময়ের ধর্মান্ধ-বর্জিত নজরুলকে কত নিন্দা এবং বিপত্তির মাঝেও সংবর্ধনা দিয়েছিলেন তার একটা স্পষ্ট ধারণা আছে এখানে।
এই প্রবন্ধসংকলনটিতে লেখক কথকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।ওনি শুধু গতশতাব্দীর চিন্তা চেতনাকে উল্লেখ করেছেন। যেমন: ‘পূরবী’ বাংলাদেশের চট্টগ্রামের মানুষের কাছে মৃতপ্রায় একটা নাম।কিন্তু একটা সময় যে পূরবী পুরো চট্টগ্রামের প্রতিনিধিত্ব করেছে তাও চট্টলার মানুষ জানে না। পাহাড়-সমুদ্রের মিলনস্থলের লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যকে, লুপ্তপ্রায় মিলন ইতিহাসকে গণমুখী করার দায়িত্বও পালন করেছে এই ‘পূরবী’। মূলকথা চট্টগ্রামের পরিচয় দিতেই আবির্ভূত হয়েছিল এই ‘পূরবী’। এমন অনেক চমকপ্রদ তথ্যে ভরপুর এই বইটি।
বইটির শেষ প্রবন্ধটির মূল বিষয়বস্তু ‘সর্দাবিল’। উনবিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকে বহুল আলোচিত বাল্যবিবাহ রোধ আইন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে নয়।তৎকালীন মুসলিম সংবাদপত্রের আলোকে। প্রাচীনপন্থীদের পরিবর্তন না হওয়ার জেদ আর প্রগতিশীলদের সমাজ পরিবর্তনের জোয়ারে তরুণদের জয়ী হওয়ার গল্পই ওনি উল্লেখ করে গেছেন। অনেক আন্দোলনের শেষে মেয়ে শিশুদের রক্ষা আইন পাশ হয়েছিল।
সম্পূর্ণ বইটির সার প্রগতিশীল আর প্রাচীনপন্থীদের দ্বন্দ্ব যা সমাজের চিরবৈশিষ্ট্য। গতশতাব্দীর তিরিশের দশকে মাসিক এবং সাপ্তাহিক সওগাত দেখা দিয়েছিলো মুসলিম সমাজের ত্রাতারূপে। যদিও অধিকাংশ মুসলিম তা বুঝতে অনেক সময় নিয়েছিল। কুসংস্কারকে সরিয়ে আধুনিকমনস্ক সমাজ তৈয়ারে এই পত্রিকা অনেক ভূমিকা রেখেছিল। বর্তমানেও কুসংস্কার প্রিয় বাংলাদেশে ধর্মীয় সংস্কার অনিবার্য হয়ে গেছে।এই সংস্কারের জন্য সবাইকে হাতে হাত ধরে এগিয়ে আসতে হবে। বইটি সংস্কারমনস্ক সব পাঠকদের অবশ্যপাঠ্য বলে আমি মনে করি। যাতে বাংলাদেশের অতীত-গৌরবকে খতিয়ে বাংলাদেশের সোনালী অতীতকে জেনে তারুণ্যের জোয়ারে উদ্দীপিত হয়ে নবজাগরণে অংশ নিতে পারে।
বইয়ের নাম : কলিকাতা কেন্দ্রিক নবজাগরণ ও বাঙালি মুসলমান
লেখক: ড. সুনীল কান্তি দের
প্রকাশক : পাঠক সমাবেশ
মূল্য : ২৯৫ টাকা
প্রকাশ : মার্চ ২০২১