গোলাম রহমান খানের ‘সুপ্ত স্মৃতি’

ছেলেবেলায় না খেয়ে না ঘুমিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কত সময় ব্যয় করেছি কত উপন্যাস পড়ে। সেসব বই পড়তে গিয়ে অবশ্য বেশ ক’বার চোখ জলে ভেসেছে। অনেককাল পরে আবারও ভিজল। তবে এবার আর উপন্যাসে নয়, আত্মজীবনীতে। সুপ্ত স্মৃতি’ একজন অন্ধ ব্যক্তির আত্মজীবনী। একজন আইসিএস (ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস) অফিসারের সাহসী অভিযাত্রার এক সংক্ষিপ্ত উপাখ্যান।
সরকারি নথি তথা ১৯৪১-৪৫ সালের বেঙ্গল সিভিল তালিকায় অবিশ্বাস্য মেধাবী এই মানুষটি ‘জি আর খান’ নামেই লিপিবদ্ধ। বর্ধমান সদরে সাব ডিভিশন সাপ্লাই অফিসার হিসেবে কর্মরত থাকার সময়ে রেটিন্যাল হেমোরেজে আক্রান্ত হয়ে তিনি অন্ধ হয়ে যান। ১৯৪৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি চাকরি থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেয়া হয়। দৃষ্টিশক্তি হারিয়েও পুনর্বার সরকারি চাকরিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা নিয়েছেন। তবে এবার আইইএস (ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিস)!
স্বল্প সময়ের মধ্যেই ব্রেইলে নিজেকে দক্ষ করে তুলেন। অন্ধ জনের জন্য যা ছিল অপরিহার্য। দেখভাল করার জন্য সার্বক্ষণিক সহযোগি হিসেবে রেখেছেন একজনকে। আরেকজনের কাজ ছিল শুধু পড়ে শোনানো। অবশেষে যোগ দেন ইসলামিয়া কলেজে। সহকর্মী হিসেবে পেয়েছেন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্তের মতো অনেক প্রাজ্ঞজনকে।
বইয়ের নাম : ‘সুপ্ত স্মৃতি’
লেখকের নাম : গোলাম রহমান খান
প্রকাশনী : শ্রাবণ প্রকাশনী
মূল্য : ১৫০ টাকা
ইতিমধ্যে দেশভাগ। স্বপ্নের কলকাতা ছেড়ে চলে আসতে হয় পূর্ব পাকিস্তানে। যোগদান করেন রাজশাহী কলেজে। অতঃপর সিলেটের এমসি কলেজ। অন্ধের কপালে না জুটে প্রেম, না ভালেবাসা। তাইতো হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়েছে বারংবার। যুগান্তর পত্রিকায় ‘দৃষ্টিহীনের শুভদৃষ্টি’ শিরোনামে এক লেখা প্রকাশের পর তাঁর প্রেমে পড়েছিলেন চিন্ময়ী পুরকায়স্থ। কিন্তু বিধি বাম। অধ্যাপকের সঙ্গে বিয়ে ঠেকাতে শেষমেষ মরফিন ইনজেকশন দিয়ে সেই নারীকে বর্ডার পার করেছিলেন তাঁর অভিভাবকরা!
পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় গৌহাটি জমিদার পরিবারের একজনার সঙ্গে। পাত্রী যেদিন জানতে পারল- জি আর খানের একটা বাল্যবিবাহ ছিল। সেদিনই সম্পর্ক ছেদ। বাল্যবিবাহ অবশ্য হয়েছিল ৯ বছরের বালক খানের সঙ্গে ৪ বছরের এক শিশু কনের। যৌক্তিক কারণে সেটা আর বাসর পর্যন্ত গড়ায়নি। কিন্তু জমিদার তনয়ার জন্য সেটাই ছিল বড় উছিলা। তুমি আমাকে এই বাল্যবিবাহের কথা জানাওনি কেন? আসলে একজন অন্ধের ঘর করতে মানসিকভাবে তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না।
‘সুপ্ত স্মৃতি’ই শুধু নয়, ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর অনন্য গ্রন্থ ‘An anatomy of Pak Economy’। যা ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বহুকাল পাঠ্য ছিল। এপার বাংলা, ওপার বাংলার চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য ‘সুপ্ত স্মৃতি’ অন্যমাত্রার এক কাহিনী।
হোসাইন মোহাম্মদ জাকি : গবেষক