ইয়স্তেন গার্ডারের ‘সোফির জগৎ’

যখন সবাই হালের আলোচিত সংবাদ নিয়ে ব্যস্ত তখন সারাদিন যাবৎ আমি লিখেছি একটি মাত্র বইয়ের রিভিউ। বইটিও একটি জাদরেল বই। রিভিউটি পড়লেই বোঝা যাবে ইয়স্তেন গার্ডারের লেখা সোফির জগৎ বইটির কথা এভাবে কেন বলছি।
এক.
সোফির জগৎ বইটি পড়ার পর পর আরও দুটি বই পড়া শেষ করেছি। কিন্তু সাহস হয়নি সোফির জগৎ বইটির রিভিউ লিখতে। এটি এমন একটি বই যার রিভিউ লিখার কথা চিন্তা করাও একটু জটিল। কারণ বইটি পড়তে পড়তে প্রতি পৃষ্ঠাতেই আমাকে দাগ টানতে হয়েছে। কোট করতে হয়েছে মোটা এবং চিকন টেক্সট মার্কার দিয়ে। এত বেশি তথ্য সমৃদ্ধ একটি বই আমার আরও বহু আগেই পড়ার প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয়েছে। কেউ যদি মনে করে দর্শন বিষয়ে মোটামুটি ধারণা থাকা প্রয়োজন তাকে সোফির জগৎ বইটি পড়তেই হবে। বইয়ের ধারণার সাথে মিল রেখে আমার নিজস্ব কিছু যুক্তি এবং উদাহারণও থাকবে রিভিউটিতে।
লেখক ইয়স্তেন গার্ডার নরওয়ের অসলোতে থাকেন। দীর্ঘকাল যাবৎ দর্শন পড়িয়েছেন নরওয়ের বার্গেন শহরে। এখনও বেঁচে থাকা এই লেখক অনবরত লিখে চলছেন। পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস নির্ভর এই বই তিনি লিখেছেন একটি উপন্যাসের ছলে। যে উপন্যাসের নায়ক একজন প্রাপ্ত বয়স্ক দার্শনিক, যার নাম অ্যালবার্টো নক্স এবং নায়িকা একজন পনের বছরের কিশোরী শিক্ষার্থী, যার নাম সোফি অ্যামুন্ডসেন। মূল বিষয় ভাবতে গেলে তাদেরকে নায়ক নায়িকা না ভেবে শিক্ষক এবং ছাত্রীই ভাবা বাঞ্ছনীয়। কারণ অ্যালবার্টো নক্স সোফিকে বিভিন্ন চিরকুট, বিশাল আকারের অনেকগুলো চিঠি এবং কাঠের দরজায় লেখা এসবের মাধ্যমে এমন কি নিজের সামনে বসিয়ে শুধুমাত্র দর্শনের পাঠ শিখিয়েছেন। যদিও উপন্যাস শেষ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বোঝার উপায় নেই যে সোফি এবং অ্যালবার্টো নক্স এর সম্পর্ক আসলে কোন দিকে যাচ্ছে।
আমি পাঠক হিসেবে একগুয়ে। আমি কখনও বইয়ের শেষে কী ঘটতে পারে তা আগে থেকে গেজ করার চেষ্টা করি না। মনে হয় মূল বিষয় অথবা শেষটা জানার পর অনেক খুঁটিনাটি বিষয় জানার বাইরে চলে যাবে। তাই আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে যাই একদম শেষ অক্ষর পর্যন্ত।
সে যা’ই হোক, সোফির জগৎ আসলে কী? বইটির নাম দেখে অনেকেই বুঝবে না সোফি একজন পনের বছরের মেয়ের নাম এবং একজন দার্শনিকের সাথে পরিচয় হবার পর থেকে দর্শনই হয়ে উঠেছিল তার একটি অনন্য জগৎ। এবং ঠিক এই কারণেই বইটির নাম লেখক দিয়েছেন সোফি’স ওয়ার্ল্ড।
“কোন এক পর্যায়ে কোনো একটা কিছু নিশ্চয়ই শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়েছিল…” এই বাক্যটি দিয়ে বইটি শুরু। এবং সাদা রঙের দুটি বেনামী খাম পাওয়ার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল একজন কিশোরীর কৌতুহল। এবং সেই যে কৌতুহল তা সোফি ধরে রেখেছিল উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত। কারণ বইটিতে এমন একটি বাক্যও আছে যার মূল কথা হলো, “আমাদের মনের কৌতুহলই আমাদেরকে ইনভেন্টিব করে তোলে”।
দুই.
আমাদের দেশে বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন আসে ‘সর্বশেষ অলিম্পিকে সবচেয়ে বেশি সোনার মেডেল কে পেয়েছে।’ এই প্রশ্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন পরীক্ষার্থীর জন্য। অথচ এমন কোন প্রশ্ন পরীক্ষায় আসে না যে, “তুমি আসলে কোথা থেকে এলে” অথবা “পৃথিবীর উৎপত্তি কোথা থেকে”। সোফির জগৎ উপন্যাসটিতে এমনই প্রশ্নে ঠাসা এবং নায়ক অ্যালবার্টো নক্স প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরই দিয়েছেন কিশোরী সোফিসহ সমস্ত পাঠককে। অ্যালবার্টো নক্স প্রথমেই সোফিকে বলেছিলেন, “আমি চাই তুমি একটি অনুসন্ধানী মনে অধিকারী হও”। সুতরাং এই একটি পরামর্শই একজন মানুষকে সারা জীবন তাড়িয়ে বেড়াতে পারে। যা বিশেষ করে অলস বাঙালির ভেতর একদমই নেই।
অবাক হবার মতো কথা হলো, লেখক আমাদের ভাবনার সাথে মিল রেখে এমন কিছু বিষয় তুলে ধরেছেন যেগুলো আমি না লিখে পারছি না। তিনি বলেছেন, সাধারণত মানুষের চিন্তা-ভাবনার দৌড় হলো এ পর্যন্ত, যেমন ধরুন, “শেয়ারবাজার আজ কতটা চাঙা হলো” অথবা “প্রিন্সেস ডায়ানা নাকি আবার মা হচ্ছেন?”। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের বিষয়গুলো আমি বলব। যেমন ধরুন, আমাদের বাংলাদেশি পত্রিকায় প্রতিদিনই বিশাল বড় ছবি দিয়ে আন্ডার লাইন আসে, “নায়িকা ববি আবার প্রেমে পড়েছেন” অথবা নায়ক সাকিব খান এবার হজ্জ্ব করবেন”। এবার বলুন, কতটা হাস্যকর বাস্তবতার মধ্যে আমরা বাস করছি। আমরা কথিত সেলিব্রেটিদের মল ত্যাগের খোঁজ খবর যতটা রাখি নিজেদের এবং ছেলে সন্তানের জ্ঞানের পরিধিরা খোঁজ ততটা রাখি না।
সোফির জগৎ বইয়ের যে লাইনটি আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়, সেটি হলো, “মনে হয় যেন বড় হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি চলার সময় আমরা বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি। আর তাতে করে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু হারিয়ে ফেলি আমরা।” ব্যাপারটি বুঝতে পেরেছেন? বিষয়টি হলো, ছোটবেলায় একটি পিঁপড়ার চলাচলের ঘটনাও আমাদেরকে কৌতুহলোদ্দীপিত করত কিন্তু ধীরে ধীরে যখন বড় হতে শুরু করেছি জগতের কোন কিছুই যেন আর আমাদেরকে টানে না। সুতরাং দ্বিতীয়বার বলছি, ‘আমাদের কৌতুহলোদ্দীপনাই আমাদের সৃষ্টিশীলতা।’
বইটির একটি বিশেষ লাইন হলো, “এই প্রথমবারের মত এ কথা বলা গেল যে, “পুরান” মানুষেরই মতামত ছাড়া কিছু নয়”। যদিও বিষয়টি বিতর্কিত। কিন্তু আমার নিজস্ব ধারণার সাথে এই লাইন একেবারের সামঞ্জস্যতা রাখে।
সকলের জানার প্রয়োজন আছে এমন সব লাইন একটি রিভিউতে তুলে দেয়া সম্ভব নয়। কারণ তাহলে রিভিউটিই হয়ে যাবে একটি ছোটখাট বই। তবুও কষ্ট স্বীকার করে কিছু লাইন না লিখলে রিভিউটি লেখাই স্বার্থক হবে না। যেমন, একটি লাইন দেখুন, “অতীতকালের নারীদেরকে নারী এবং চিন্তাশীল মানুষ এই দুই দিক থেকেই অবদমিত করে রাখা হয়েছিল, যা খুবই দুঃখজনক, কারণ এর ফলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতার একটি বিরাট অংশই হারিয়ে গেছে।” কি দারুণ বাস্তব সত্য। ভেবে দেখুন, নারী-পুরুষকে সমানতালে এগিয়ে যেতে দিলে পৃথিবী এখন আরও বহুগুণ এগিয়ে থাকত কিনা?
তিন.
প্রথমেই বলেছি, সোফির জগৎ বইটি এমন বই যে, প্রতি পৃষ্ঠায় আমাকে কোট করতে হয়েছে। মূলত বইটি লেখা হয়েছে পৃথিবীর পাশ্চাত্য অঞ্চলের প্রচীনতম থেকে শুরু করে কমপক্ষে ১৮০০ শতাব্দি পর্যন্ত দার্শনিকদের নানান ভাবনা চিন্তা। প্রাচীনতার কথা বিচার করলে পৃথিবীর প্রথম দার্শনিক হলেন “থেলিস”, যার জন্ম হয়েছিল ৫৮৫ বিসি বা খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে। তার জন্ম হয়েছিল এশিয়া মাইনরের মিলেটাসে। এর পরবর্তী যে দার্শনিকের ব্যাপারে সামান্য তথ্য পাওয়া যায় তার নাম “অ্যানাক্সিম্যান্ডার”। এর পর আসে “পার্মেনিদেস” এর নাম। এসব দার্শনিকেরা সবাই’ই প্রাণের আবির্ভাব, পৃথিবীর উৎপত্তি এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়েছিলেন।
আবার বলি, এই যে এত দার্শনিকদের নিয়ে বইটি লেখা, এগুলো সবই গল্পচ্ছলে সোফি অ্যামুন্ডসেনকে বিভিন্ন উপায়ে বলে যাচ্ছেন অ্যালবার্টো নক্স। যিনি ইতিমধ্যে হয়ে উঠেছেন সোফির জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন। এবং সোফির মা যাকে ভেবেই নিয়েছেন নক্স হয়ত সোফির কোন বয়ফ্রেন্ড। কারণ সোফি প্রায় প্রতিদিনই অ্যালবার্টো নক্স এর নিকট থেকে চিঠি পায় এবং মাঝে মাঝেই সে কোথায় যেন উধাও হয়ে যায়। সোফির মা আঁচ করতে পারেন, সোফি নিশ্চই অ্যালবার্টো নক্স এর সাথে কোথাও না কোথাও দেখা করতে গিয়েছে। এবং সত্যি বলতে সোফি ঠিক তা’ই করত। অথচ এই দেখা করা কিন্তু গোপন কোন অভিসার নয়। এটি ছিল দর্শনের ক্লাস। কারণ ইতিমধ্যে সোফির সবচেয়ে বৃহৎ কাজ হয়ে উঠেছে অ্যালবার্টো নক্স এর কাছ থেকে দর্শনের গল্প শোনা এবং জগৎ সম্পর্কে আকাশ পাতাল ভাবা।
সোফির জগৎ বইটিতে এরপর এসেছে প্রাচীন “হেরাক্লিটাস এবং এম্পিডক্লেস” এর দর্শন। এই দুজনের পরই এসেছে প্রাচীন “অ্যানাক্সাগোরাস” এর কথা। অ্যানাক্সাগোরাসকে বলা হয় এথেন্সের প্রথম দার্শনিক, যাকে নাস্তিকতার অভিযোগে শহর ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। এটাই সত্য এবং ইতিহাস তা’ই বলে যে, সাধারণের বাইরে অসাধারণ এবং অন্তরচক্ষুসম্পন্ন যারা তাদের অধিকাংশেরই ভাগ্যেই জীবনের নানা সময়ে নেমে এসেছিল নানান বিপর্যয়। তারা সেসব মেনে নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন। অ্যানাক্সাগোরাস এর পরেই আসে “ডেমোক্রিটাস” এর নাম।
ডেমোক্রিটাসই প্রথমে পরমানু তত্ত্বের ধারণা দিয়েছিল বলা হয়ে থাকে। শুনে অবাক লাগলেও সত্য যে, ডেমোক্রিটাসই সেই ব্যক্তি যিনি পারস্যের রাজার হবার বদলে প্রকৃতির একটি নতুন কারণ বা তত্ত্ব আবিস্কারকে বেশি মূল্যায়ন করতেন। এবং এর পরবর্তীতেই আসে দার্শনিক “হিপোক্রিটাস” এর নাম।
প্রাচীনতম এসব দার্শনিকের পরই বইটিতে এসেছে বহুল আলোচিত দার্শনিক “সক্রেটিস” এর নাম। যিনি পথে পথে ঘুরে মানুষকে জ্ঞান শিক্ষা দিতেন। যিনি দেখতে ছিলেন অসুন্দর এবং কদাকার। অথচ ওরাকল নামক এক ব্যক্তির ভাষ্যমতে সক্রেটিসই ছিলেন এথেন্সের সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি এবং যাকে ৩৯৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে হেমলক রস খাওয়ানোর মাধ্যমে হত্যা করা হয়। সক্রেটিসের পরে আসে তার শিশ্য প্লেটো এবং পরবর্তীতে এরিস্টটল এবং আলেকজান্ডারের নাম। এই তিন দার্শনিক এবং এক ইম্পেররের কথা মোটামুটি সবার জানা। সক্রেটিস বলতেন, “হাজারটা উত্তরের চেয়ে একটা প্রশ্ন অনেক বেশি বিস্ফোরক।” এবং তিনি পথেঘাটে মানুষকে ধরে ধরে শুধু প্রশ্নই করতেন। অথচ অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, সক্রেটিস কোন কিছুই লিখে যাওয়ার পক্ষপাতি ছিলেন না। তার যে ধারণাগুলো আমরা এখন পাচ্ছি তা তার হয়ে তার শিশ্য প্লেটোই আমাদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন।
চার.
বইটিতে আছে সোফিস্টদের কথা, যারা তখনকার যুগে এথেন্স এবং গ্রীসে জ্ঞান চর্চা করতেন এবং মানুষের শিক্ষক হিসেবে কাজ করতেন। মূলত সোফিস্ট মানেই জ্ঞানী বা প্রজ্ঞাবান।
এরিস্টটল ছিলেন সেই সোফিস্টদেরও শিক্ষক। তিনি ছিলেন এমন দার্শনিক যিনি পৃথিবীর সমস্ত কিছুকে ঢেলে সাজাতে চেয়েছিলেন। এবং তিনিই বৃক্ষ এবং প্রাণীকে বিভিন্ন প্রজাতিতে বিভক্ত করার ধারণা সূত্রপাতকারী। তিনি ঈশ্বরকে বলতেন ফার্স্ট মুভার।
বইটিতে একটি চরিত্র আছে হিল্ডা। যাকে উদ্দেশ্য করে একজন মেজর চিঠি লিখতেন। অথচ চিঠিগুলো আগে আসতো সোফির কাছে। সত্যি বলতে এটি ছিল সোফিকে পড়ানোর একটি কৌশল। বইটিতে বিবেকের সংজ্ঞা এভাবে দেয়া হয়েছে যে, “বিবেক হচ্ছে ন্যায়-অন্যায়ের ব্যাপারে মানুষের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার ক্ষমতা।”
আমরা বইটিতে এর পরেই পাবো “স্টোয়িক” দর্শনের কথা। স্টোয়িক বলতে আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে বিরাগীদের সাথে। অর্থাৎ যারা কোন কিছুর প্রতিই আগ্রহ প্রকাশ করতেন না। বরং তারা জীবনকে সুখ স্বচ্ছন্দের বাইরে রাখতেই বেশি পছন্দ করতেন। এমনই অন্য একটি পথ রয়েছে, যাকে বলা হয় “সিনিক দর্শন”। “ডায়োজেনেসিস” নামক এমন এক দার্শনিক ছিলেন যিনি বিবাগী ছিলেন এবং সংগতি থাকার পরও তিনি থাকতেন রাস্তার পার্শ্বের বড় আকারের একটি কলসির ভেতর। সিনিক দর্শন এবং দার্শনিক ডায়োজেনেসিস এর নামটি আমি জানতে পেরেছি নিশিক্তের অডিও বুক “ফিলোসোফি পাঠ” থেকে।
এবং এর পরেই আমরা শুনব দার্শনিক “সিসেরোর” কথা। যাকে বলা হয় মানবতার ধারণার স্রষ্টা।
এবং ঠিক এর পরেই আসে “সাইরেনাইক এবং এপিকিউরিয়দের” কথা। সাইরেনাইক বলতে বোঝানো হয় ভোগবাদকে। যে তত্ত্বের স্রষ্টা ছিলেন দার্শনিক প্লেটোরই শিশ্য দার্শনিক “এরিস্টিপপাস”। এবং যিনি মনে করতেন, “আনন্দের চেয়ে ভালো আর কিছু নেই।” সত্যি বলতে সাইরেনাইক বা এপিকিউরিয়দের ঠিক বিপরীত অবস্থানে ছিল স্টোয়িক এবং সিনিকরা।
বইটিতে এরপর আসে “মরমীবাদ এবং সীমাইটদের” কথা। যারা গোড়ার দিক থেকেই এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী। আসে “সেমিটিক এবং হেলেনিস্টিকদের” কথা। এর পর আছে ইন্দো ইউরোপের ইতিহাসের অংশ এবং ইহুদী ধর্মের কিছু আলোচনা। যার হাত ধরে আসে যিশু, পল। এবং আমরা এদের হাত ধরে চলে আসি মধ্যযুগে। আমরা চলে আসি সেন্ট অগাস্টিন এর কাছে। যিনি বলতেন “মানুষ আধ্যাত্মিক প্রাণী।” আসে সেন্ট টমাস এ্যাকুইনাস। আসে বাইবেল বিতর্ক এবং নারী পুরুষের সৃষ্টির কিছু তর্কতত্ত্ব।
পাঁচ.
ঠিক মধ্যযুগের পরই আসে রেনেসা। যে যুগে শিক্ষা দীক্ষার দিক দিয়ে শুরু হয় নব বিপ্লবের। এবং হিল্ডা এবং সোফির কাছে অনবরত আসতে থাকে নতুন নতুন তত্ত্বের নতুন নতুন চিঠি। এবং রেনেসার যুগেই ইংরেজ দার্শনিক “ফ্রান্সিস বেকন” এর জন্ম হয়। যিন বলেন একটি বিখ্যাত উক্তি, “জ্ঞানই শক্তি”। এবং আমরা আসি বৈপ্লবিক চিন্তার নতুন দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী “গ্যালিলিও” এর কাছে। যিনি খ্রিষ্ট ধর্মের সাথে দ্বন্দমূলক একটি তত্ত্বের আবিস্কার করে খ্রিষ্টীয় যাযক এবং উচুমহলের রোষাণলে পতিত হন। এবং তাকে বেঁচে থাকার জন্য ইচ্ছের বিরুদ্ধে ক্ষম চাইতে হয়।
সত্যি বলতে এখনকার যুগের মতই যত উচু মহলের হোক না কেন অন্ধ মানে অন্ধই। যারা সত্যকে সহজে মেনে নিতে পারে না। এবং এখনও পৃথিবীজুড়ে একই অবস্থা বিরাজমান। কট্টর ধর্মপুজারীরা নতুন আবিষ্কারকে কখনোই মেনে নিতে পারে না। যদিও তারা পরবর্তীতে সেসব আবিষ্কারের ফল পরিপূর্ণভাবে ভোগ করে নির্লজ্জের মত। এবং অবাক হলেও ঠিক একইভাবে পরবর্তীতে গ্যালিলিওর ধারণাই সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। যদিও তার জীবদ্দশায় শতভাগ লোকই ছিল তার মতবাদের বিরুদ্ধে। এখনও মেজরিটিকেই মূল্যায়ন করা হয়। অথচ পৃথিবীর অল্প কিছু মানুষই সত্যিটা দেখার চোখ নিয়ে জন্মায়। এবং যে কোন যুগেই নিরানব্বই ভাগ মানুষই থাকে সেই একজন সম্পর্কে বিরূপ এবং প্রকৃতি সম্পর্কে অজ্ঞতায় পরিপূর্ণ। এবার আপনি ভাবুন, আপনি কি সাময়িক জনপ্রিয়তার খাতিরে সেই নিরানব্বই জনকে সাপোর্ট করবেন, নাকি সকলের বিরূপ একজনকে, যার চিন্তাধারা মেজরিটির সাথে সাংঘর্ষিক?
সে যা’ই হোক, গ্যালিলিও’র মতো ভাগ্য নিয়ে আরও একজন দার্শনিক জন্মেছিলেন যার নাম ছিল “জিওর্দানো ব্রুনো”। এবং যার মতবাদ প্রচলিত জনপ্রিয় ধর্মের বিরুদ্ধে যাওয়ার ফলে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে তাকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। অথচ তার মতবাদও পরবর্তীতে সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। অথচ অন্ধ ধর্ম কখনোই সত্যকে গ্রহণ করতে পারেনি। যুগে যুগে যার জন্য বলি হতে হয়েছিল শতাব্দির সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষদের। এবং এখনও এই আগ্রাসন চলমান। এখনও প্রচলিত ধর্মের বিরুদ্ধে মুষ্ঠিমেয় যারা বলে তাদেরকে হত্যা করা হয়। অথচ যারা হত্যা করে তাদের নাম যুগের সাথে ধুলোয় মিশে যাবে, কিন্তু যাকে হত্যা করা হবে সে আরও নতুনভাবে বেঁচে উঠবে শতশত বছর পর হলেও।
ছয়.
বইটিতে পরবর্তীতে আসে দার্শনিক “ডেমোক্রিটাস” এর নাম। এবং আসে দার্শনিক “দেকার্তে” এর নাম। যাকে বলা হয় আধুনিক দর্শনের জনক। এবং আমরা এক এক করে আসি দার্শনিক “স্পিনোজা’র” কাছে। ধর্মবিরোধী এই ইহুদী দার্শনিককে তার সত্য মতবাদের জন্য তার সম্প্রদায় থেকে বহিষ্কার করা হয়। স্পিনজো অসম্ভব সব সুন্দর ব্যাখ্যা এবং তত্ত্ব দিয়েছেন পৃথিবীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে। এবং আমি স্পিনজোর বিষয়ে জানার পর বইটির পাতায় লিখে রেখেছি, “আই লাভ স্পিনজো”। এবং স্পিনজোই ছিলেন শতাব্দীর সেরা দার্শনিক।
স্পিনজোর পর পরই বইটিতে এসেছে “জন লক” এর কথা। আসে দার্শনিক “হিউম”। যিনি ছিলেন অভিজ্ঞতাবাদী এবং একই সাথে বুদ্ধিবাদী দার্শনিক।
ইয়স্তেন গার্ডার সোফির জগৎ বইটির ২৯০ পৃষ্ঠায় সোফিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। যেটি হলো, “সেফি, এই কোর্স এর মাধ্যমে তোমাকে আমি যদি মাত্র একাটি জিনিসও শেখাতে চাই তো সোটা হলো হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়া।” ব্যক্তিগতভাবে আমার দারুণ পছন্দ হয়েছে কথাটি। আমি লাইনটি কোট করে সাইন করে রেখেছি।
সে যা’ই হোক, এর পরেই আসে মহান দার্শনিক “বুদ্ধের” কথা। প্রাণী জীবন সম্পর্কে যার দর্শন ছিল অনন্য। যিনি ধর্মের জগতে প্রচলিত এবং কল্পিত ঈশ্বরবিহীন নতুন ধারণার প্রবর্তন করেন। যিনি জীবকে ভালোবাসার কথা বলেন এবং জগতের মুক্তিই ছিল যার ধ্যান ও জ্ঞান। তার ব্যাপারে যেহেতু সকলেই অবগত সেহেতু খুব বেশি বলার প্রয়োজন নেই।
এর পরই আসে “বার্কলের” কথা। যিনি ছিলেন একজন অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক। আসে দার্শনিক “কান্ট” এর কথা। এবং বইটির মাধ্যমে আমি নতুন এ তথ্যটি জানলাম যে, “কান্ট ছিলেন জাতিসংঘের ধারণার জনক।” বইটির ৩৫৫ পৃষ্ঠায় আমরা একটি দারুণ লাইন দেখতে পাই, যেটি হলো, “দর্শন রুপকথার ঠিক বিপরীত”। এই লাইনটির শেষেও আমি সাইন করি। মূলত দর্শন হলো যুক্তি এবং তত্ত্ব। এখানে কল্পনা এবং অন্ধ বিশ্বাসের কোন অবকাশ নেই। বলা হয়েছে, “যা দেখো তা’ই বিশ্বাস কোরো না”। মূলত এগুলোই দর্শনের মূল বিষয়। দর্শন আসলে যাচাই করা, অন্তরদৃষ্টি দিয়ে দেখা এবং হৃদয় দিয়ে সত্যকে উপলব্ধি করার চেষ্টা।
সাত.
এরপর আসে রোমান্টিসিজমের কথা। আসে “কার্ল মার্ক্স এবং এ্যাঙ্গেলেস” এর হাত ধরে প্রলেতারিয়েত এবং বুর্জোয়াদের আলোচনা। আমরা অনেকেই এই বিষয়গুলো জানি। বইটি পড়লে আরও গভীরভাবে জানা যাবে আশা করি। এরপর আসে মানব জগতের এক প্রলয় সৃষ্টিকারী তত্ত্বের জনক “চার্লস ডারউইনের” নাম। নতুন করে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। ডারউইনের নাম শোনেনি এমন মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই পাওয়া যাবে। যার হাত ধরে আমরা পাই বিবর্তনবাদের দারুণ দারুণ তত্ত্বগুলো।
এরপর আসে সর্বজ্ঞানের পণ্ডিত “ফ্রয়েড” এর নাম। যিনি সৃজনশীলতার সংজ্ঞা দিয়েছেন। সংজ্ঞা দিয়েছেন নতুন চিন্তার ধারণার। যদিও নারীদের নিয়ে বিরূরূপ ভাবনার জন্য আমি এরিস্টটল এবং ফ্রয়েডকে অপছন্দ করি। সে যাক…
ঠিক এর পরেই একটি অধ্যায় হলো, “আমাদের নিজেদের কাল”। যে অধ্যায়ের মধ্যে আলোচনা করা হয় ইয়স্তেন গার্ডার এবং সোফির দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা এবং বিভিন্ন দার্শনিকদের সাথে নিজেদের আলোচনার সমালোচনা। আসে দার্শনিক “নিটশে” এর নাম। এবং বইটি শেষ হয় একটি গার্ডেন পার্টির মধ্যে দিয়ে। যে পার্টিতে সোফিকে দর্শন শিক্ষা দেয়া শেষ হয়। এবং একটি দারুণ ভোজনসভা হয় সেদিন। এবং সকলের মাঝেই এক রুপবান যুবকের সাথে সোফির বান্ধবী চলে যায় শারীগত অভিসারে। এবং ঠিক সেদিনই ইয়স্তেন গার্ডারের কল্পিত সোফি এবং এ্যালবার্টো নক্স হারিয়ে যান।
একটি চমৎকার বইয়ের ধারণাগুলোকে কখনোই এত ছোট করে টাচ করা সম্ভব নয়। তবুও আমি চেষ্টা করেছি আমার নিজের মত করে। যারা বইটি পড়েননি আশা করি তাদের জন্য এই রিভিউটি কাজে লাগবে। এবং সোফির জগৎ বইটি পৃথিবীর ইতিহাসে একটি অনন্য বই। বইটি প্রত্যেক মানুষেরই অন্তত একবার পড়া উচিত। শুভ কামনা। শুভ বই পড়া।