‘হাঙর নদী গ্রেনেড’-মায়ের ত্যাগের আখ্যান

‘বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্য’, ‘মধ্যযুগের বাঙলা গীতিকবিতা’সহ বর্তমানে সম্মান শ্রেণির বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত রেফারেন্স বইগুলোর বিষয়বস্তুর সাথে নামকরণে কিঞ্চিৎ দূরত্ব লক্ষ্য করা যায়। খেয়াল করলে আরও দেখা যায়, এ সকল বইয়ের সম্পাদনার কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত ধ্বনিবিজ্ঞানী প্রফেসর মুহম্মদ আবদুল হাই। বলাবাহুল্য, পাকিস্তান আমলে মৃত্যুর আগেই তিনি এসব করে যান। পাঠক্রম প্রণয়নের দায়িত্ব তাঁর হাতেই ছিল। যেহেতু ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হয় এবং ভাষার প্রশ্নে আমাদের সাথে পাকিস্তানিদের প্রথম বিরোধ সূচিত হয়, সেহেতু একাত্তরপূর্ববর্তী সময়ে মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের এ কাজগুলো যথেষ্ট দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করে।
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ নিয়ে লিখতে গিয়ে অপ্রাসঙ্গিক ভূমিকা ফেঁদে ফেলেছি কিনা, চিন্তার বিষয়। আসলে উপন্যাসে বাউলসম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র নীতা। তার সাথে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র বুড়ির ছোটবেলা থেকেই সদ্ভাব গড়ে ওঠার কথা জানা যায়। নেত্রকোণার সোমেশ্বরী নদীর তীরবর্তী জনপদের যুদ্ধকালীন বাস্তবতা মোটাদাগে ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসে উঠে এসেছে। অবশ্য সময়রেখা বিবেচনায় চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৯৭১ সাল, বলা যায় এই এক প্রজন্মকালের কাহিনী এ উপন্যাসে গ্রথিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে যদি বলি এটা কেবল মুক্তিযুদ্ধেরই উপন্যাস, কিছু ভুল বোধকরি রয়ে যায়। বরং স্বাধীনতার উপন্যাস বলতে পারলে এর উপজীব্য বোঝানো সহজ হবার কথা। সেক্ষেত্রে বুড়ি এবং নীতাকে আগাগোড়া আক্ষরিক অর্থেই প্রতীকী চরিত্র হিসেবে বুঝতে হবে পাঠকের। মার্ক্সবাদী চিন্তাচেতনা মন থেকে সরিয়ে রেখে বলা যায়, কখনো সম্পূর্ণ স্বাধীন, কখনো সমাজের শিকলে বাঁধা বুড়ি। কিন্তু নীতা জাগতিক নিয়মকানুনের বন্ধনে আবদ্ধ কেউ নয়। বরং গাঁয়ের পথে পথে ঘুরে গানে গানে মনের মানুষ খুঁজে দিন যায় তার। নেই মায়ের শাসন, ভাইয়ের চোখরাঙানি অথবা স্বামীর মারধর।
মারধর গফুরও করেনি কখনো বুড়িকে। বরং দাম্পত্যপ্রেমের এক বিরল নিদর্শন দেখা যায় তাদের মধ্যে। সমসাময়িক বাঙালি সমাজের জীবনালেখ্য ‘হাজার বছর ধরে’ লিখতে গিয়ে জহির রায়হান দেখিয়েছিলেন সালেহাদের ওপর কীভাবে স্বামিত্ব ফলায় আবুলেরা। এ ব্যাপারটি ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’-এর সাথেও সংগতিপূর্ণ। সে কথায় একটু পরে আসছি।
প্রসঙ্গত নিম্নবর্গের সাহিত্যে বিশুদ্ধ দাম্পত্যপ্রেমের অস্তিত্ব তেমন বাস্তব নয়। জসীম উদ্দীনের লেখায় যদিও কিছুটা দেখা যায় এ বিষয়টি।
গফুরের সাথে বুড়ির বয়সের পার্থক্য, উপন্যাসের সময়রেখা, সামাজিক বাস্তবতার নিরিখে এমন কিছুর সৃষ্টি নিশ্চিতভাবেই সেলিনা হোসেনের বড়ো কৃতিত্ব।
এক্ষেত্রে তিনি লিখেছেন
“শান্ত পানিতে নৌকা ভাসে। গফুর বৈঠা ছেড়ে দিয়ে বুড়িকে কাছে টেনে নেয়। বুড়ির কিশোরী ঠোঁটে অপূর্ব মাধুর্য। গফুর পাগলের মতো নেশা খোঁজে। দিক ভুল হয়ে যায় গফুরের। কোনো দিশা করতে পারে না। বুড়ি এখন অনেক কাছের-অনেক উষ্ণ-অনেক মিনতি ভরা। …”
অন্যদিকে জসীম উদ্দীনের ‘বোবা কাহিনী’ উপন্যাসে দাম্পত্যপ্রেম এসেছে –
“বউ একটু হাসিয়া আঁচলের বাতাসে কেরোসিনের কুপিটি নিবাইয়া আজাহেরের মুখে একটি মৃদু ঠোক্না মারিয়া বিছানার উপর যাইয়া শুইয়া পড়িল। আজাহের বউ-এর সমস্ত দেহটি নিজের দেহের মধ্যে লুকাইয়া তার বুকে মুখে ঘাড়ে সমস্ত অঙ্গে মুখ রাখিয়া কেবলই বলিতে লাগিল, “আমার একটা বউ ঐছে–সোনা বউ ঐছে–লক্ষ্মী বউ ঐছে–মানিক বউ ঐছে। তোমারে আমি বুকে কইরা রাখপ–তোমারে আমি কলজার মধ্যে ভইরা রাখপ–আমার মানিক, আমার সোনা, তোমারে মাথায় কইরা আমি মাঠ ভইরা ঘুইরা আসপ নাকি? তোমারে বুকে কইরা পদ্মা গাঙ সাঁতরাইয়া আসপ নাকি? আমার ধানের খ্যাতরে, আমার হালের লাঠিরে–আমার কোমরের গোটছড়ারে–আমার কান্ধের গামছারে। তোমারে আমি গলায় জড়ায়া রাখপ নাকি?”
দেখা যাচ্ছে, জসীম উদ্দীন সংলাপ রচনায় জোর দিয়ে লিখেছেন। অন্যদিকে সেলিনা হোসেন ডিটেইলিংয়ে ভর করে গল্প বলে গেছেন।
বুড়ির সৎপুত্র সলীমকে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নারী নির্যাতনকারী হিসেবে দেখিয়ে মূলত গফুর-বুড়ির সম্পর্ককে আর দশটা সম্পর্ক থেকে আলাদা করার চেষ্টায় সফল ঔপন্যাসিক। গফুরের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত উপন্যাস একই ধীরগতিতে এগিয়ে গিয়েছে। কিন্তু একঘেয়েমি পেয়ে বসবে না পাঠককে। তার কৃতিত্ব পুরোটাই সেলিনা হোসেনকে দিতে হয়।
উপন্যাসের শুরুর দিক থেকেই প্রাকৃতিক পরিবেশের মনোরম বিবরণে মনোযোগ দিয়ে গেছেন ঔপন্যাসিক। বুড়ির চোখ দিয়ে আমাদের দেখিয়েছেন কচুরিপানা আর শিমের বেগুনি ফুল, পুকুরে-খালে বাঁশঝাড়-ঝোপঝাড়ের বুনো সৌন্দর্যসহ বহু অভব্যসুন্দর প্রাকৃতিক বাস্তবতা। আবার প্রতীকায়িত পরিচর্যায় আঁধার, মাছ-শালুকের আলঙ্কারিক প্রয়োগ এমনকি কুটুম পাখির প্রাসঙ্গিকতায় গ্রামে মিলিটারি আগমনের বর্ণনা – এসব নিঃসন্দেহে ঔপন্যাসিকের শিল্পরুচির পরিচয় দিয়েছে। নারীপুরুষের যৌন সম্পর্কের মতো স্পর্শকাতর প্রসঙ্গের অবতারণায়ও শিল্পমান ক্ষুণ্ণ হয়নি।
জসীম উদ্দীনের ‘বোবা কাহিনী’ উপন্যাসের উদাহরণ এখানেও টানা যায়। টানা যায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের প্রাকৃতিক পরিবেশের শিল্পিত বিবরণের উদাহরণ।
১৯৭১ এর ২৫ মার্চ রাতে বাঙালির ওপর একেবারে অতর্কিত আক্রমণ করে বসে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। কিন্তু তার আগে থেকেই তীব্র অসন্তোষের দানায় বাঙালিদের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা আসতে থাকে। বুড়ি এসব টুকটাক টের পেলেও বুঝে উঠতে পারেনি কী ঘটতে চলেছে। সেরকম অতর্কিতেই প্রথম শোনে দেশের অবস্থা ভালো না, মানুষ স্বাধীনতা চায়, দেশ স্বাধীন হবে। এখানেই বুড়ির আপত্তি অথবা দ্বিধা – স্বাধীনতা বুড়ি আগেও দেখেছে। এরকম দমবন্ধ পরিস্থিতি হয়নি তখন দেশে। স্বাধীনতার আনন্দে উদ্বেল হয়েছে সবাই। কিন্তু এবার কলীমের বিয়েটাই আটকে দিতে হলো স্বাধীনতার প্রয়োজনে?!
এ প্রসঙ্গে আবু ইসহাকের ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’ উপন্যাসের কথা তোলা যায়। ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’-এর আকস্মিক পটবদলের আগ পর্যন্ত যে একটা শান্তিপূর্ণ গ্রামীণ জীবনালেখ্য দৃশ্যমান, সেরকমই শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিতে ভূখণ্ডে পটপরিবর্তন দেখানো হয়েছে আবু ইসহাকের লেখায়। সেলিনা হোসেন বুড়ির আখ্যানে দুই স্বাধীনতা অর্জনের একটা তুলনামূলক চিত্র আঁকার প্রয়াস পেয়েছেন।
নীতাদের আখড়া পুড়েছে যুদ্ধের সময় গোলার আগুনে, অখিল বাউলের মতো যারা দেশ নিয়ে ভাবতো, তাদের বুকে চলেছে গুলি। শুধু অখিল বাউল নয়, তখন মনসুরের মতো হাতেগোনা কিছু বিশ্বাসঘাতক ছাড়া সবাই যে যার জায়গা থেকে দেশের জন্য কিছু করতে চেয়েছে মনেপ্রাণে। নীতা যেমন প্রেম, দেহতত্ত্ব ভুলে দেশ নিয়ে গান করেছে।
সমকালীন লেখায় মিলটন রহমান এমন এক বাউলকে এনেছেন তাঁর লেখায়। হরিহর বাউল প্রকাশিতব্য ‘ইদ্দতকালে ভিন্ন স্বর’ উপন্যাসে দেখানো এক দেশদরদী বাউল চরিত্র।
রমিজা সলীমকে মনে করে বেশি করে পিঠা পাঠিয়েছে। সেই পিঠার ভালোবাসা ভুলে সময়ের সবচে বড়ো ভালোবাসার ডাক, দেশের ডাকে সাড়া দিয়ে তখন যুদ্ধ করছে সলীম। যুদ্ধে গেছে রমজান আলীর ছোটো ছেলেরাও। প্রাণ দিয়েছে সলীমের ছোটভাই কলীম। তবু যখনই পাকসেনারা সলীমের ব্যাপারে জানতে চেয়েছে কিছু, সবাই একশব্দে বলেছে – জানিনা। শুধু বুড়ির মন ভরছিলো না। দেশের জন্য কিছু করবার তাড়না নিজের মধ্যে ত ছিলই। সে তাড়নার মন্ত্র আরো একজনের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট সে – তার বহু সাধনার সন্তান রইস। অথচ রইস ছিল বুদ্ধি প্রতিবন্ধী।
উপন্যাসে অসংখ্যবার বাঁকবদলের শিকার বুড়ির জীবনের সবচে বড়ো ট্র্যাজেডি যদি রইস হয়, তবে তার সবচে বড়ো শক্তির জায়গাও ছিল রইস। এই সবেধন নীলমণিকে পাওয়ার জন্যে যে সাধনা করতে হয়েছে বুড়িকে, তা তুলনাহীন। বুড়ি শৈশব থেকে আর দশজন থেকে আলাদা হয়েছে। জলিলের সাথেই যা একটু মিলত। ভাগ্যবিধাতা সেখানে মিল না রেখে মেলালেন গফুরের সাথে।
গফুরের মৃত্যুর পর শুরু নতুন সংগ্রাম। সলীম, কলীম, রমিজা, রইসকে নিয়ে সেই অস্তিত্বের সংগ্রামে ভাঁটা পড়ে রইস ছাড়া বাকি সকলে একে একে চলে গেলে। সলীম যুদ্ধে, কলীম শহীদ, রমিজা বাপের বাড়ি।
তখন উত্তাল হলদী গাঁ। রমজান আলীর ছেলেদের আশ্রয় দিতে হাবাগোবা রইসের হাতে তুলে দেয় ঘরে লুকানো এলএমজি। ওদিকে ঘরের ভেতর মটকায় লুকিয়ে আছে দুই মুক্তিযোদ্ধা। পরক্ষণেই গুলির শব্দের সাথে রইস একটা টকটকে লাল তাজা বোমা হয়ে গেছে। বুড়ি হয়ে গেছে সারা বাঙলার দামাল ছেলেদের মা।
(উপন্যাসটি অবলম্বনে ‘হাঙর নদী’ নামে একটা সিনেমা করার পরিকল্পনা হয়। তখন কিশোর রইসের চরিত্রে সালমান শাহকে নিয়ে শুটিং হয়েছিল। সে সময় কাজটি শেষ করা যায়নি অজানা কারণে। পরে ১৯৯৭ সালে পুনর্নির্মাণ করা হয় ছবিটি। তখন সালমান আর বেঁচে নেই। রইস চরিত্রটি করেছেন অভিনেতা বিজয় চৌধুরী। বুড়ির চরিত্রে ছিলেন অভিনেত্রী সুচরিতা।)
🅒 রেজওয়ান আহমেদ : শিক্ষার্থী, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য (৬ষ্ঠ আবর্তন), বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।
পাঠ প্রতিক্রিয়া চমৎকার হয়েছে।
তবে