নজরুল: রুবাইয়াৎ-ই ওমর খৈয়ামের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ভাষার অমর ও অবিসংবাদিত এক কবি। তাঁর কলমি শক্তির সৃষ্টিতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য হয়েছে পুষ্পময় কানন। এই ভাস্বর কবি ১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, সংগীত, পত্রিকা সম্পাদনা, অনুবাদ, সংগীত পরিচালনা, চলচ্চিত্র পরিচালনাসহ শিল্প-সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় অসামান্য অবদান রেখেছেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট বাংলা সাহিত্যকে ঋণী করে তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। পবিত্র কুরআন থেকে শুরু করে বিশ্ব সাহিত্যের বিখ্যাত কিছু গ্রন্থও তিনি সাবলীল অনুবাদ করেছিলেন। সেই অনুবাদগুলি হলো: দিওয়ানে হাফিজ, কাব্যে আমপারা ও রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম। তাঁর অনুবাদ কর্মগুলো বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে দিয়েছে বহমান এক গতি। তাঁর অনুবাদ কর্মগুলো ছিল মৌলিক ও সাহিত্যিক মানে অনন্য। নজরুলের করা অনুবাদগুলির মধ্যে ‘রুবাইয়াৎ-ই- ওমর খৈয়্যাম’ সাহিত্য বোদ্ধা, সাহিত্য সমালোচক ও সাহিত্যরস সন্ধানীদের নিকট প্রশংসিত ও সর্বোচ্চ গ্রহণীয়।
আমি ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের একজন ছাত্র ও গবেষক হিসেবে যখন ফারসি ভাষার অমর সৃষ্টি, ইরানের মনীষী ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী ওমর খৈয়্যামের রুবাইয়াৎ বুঝতে চাই তখন বিজ্ঞ অনুবাদক নজরুলের অনুবাদটি আমাকে বুঝতে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করে। অন্যান্য অনুবাদগুলি ফিটজেরাল্ডের আধো আধো ও ভোগবাদীতার ছাপে প্রচ্ছন্ন। তাই যদি কেউ মূল রুবাইয়াৎ এর স্বাদ গ্রহণ করতে চায়(বাংলায়) তবে অবশ্যই তার উচিত হবে নজরুলকৃত অনুবাদটি পড়া। অমর সৃষ্টি রুবাইয়াৎ-ই ওমর খৈয়্যাম স্রষ্টা ওমর খৈয়াম (১০৪৮-১১২৩) প্রাচ্য (পারস্য) মনীষী। তাঁর মনন ও মেধা আপন স্বকীয়তায় প্রোজ্জ্বল হয়েছেন, জ্ঞানের যতগুলো শাখায় তিনি ছোঁয়া দিয়েছেন সব শাখাতেই। প্রতিটি শাখাকেই করেছেন সমৃদ্ধ জ্ঞান পিপাসুদের করেছেন ঋদ্ধ। বীজ গণিতের আবিষ্কারক, প্রথম সৌর পঞ্জিকার আবিষ্কারক এই বিজ্ঞানী ছিলেন একজন জ্যোতির্বিদ। তিনিই প্রথম পারস্যে মান মন্দির স্থাপন করেন, এবং অনেক গ্রহ নক্ষত্র আবিস্কার করেছিলেন। একজন সুফি দরবেশ হিসেবে যেমন সমাদৃত তেমনি ধর্মান্ধ কর্তৃক নাস্তিক ঘোষিত হওয়া এবং তাঁদের হাতে জীবনের বিভিন্ন সময়ে নিগৃহীত হয়েছেন, রক্তাক্ত হয়েছেন, হয়েছিলেন চাকরিচ্যুত। এমনকি ধর্মান্ধদের পরামর্শে শুদ্ধ হওয়ার জন্য হজ্ব ব্রত পালন করতে গিয়ে আরেকদল ধর্মান্ধ কর্তৃক মক্কা শরিফে লাঞ্চিত হন এবং বিতাড়িত হন। বর্তমানে ওমর খৈয়াম বহুল আলোচিত একজন কবি হিসেবে একজন দার্শনিক হিসেবে। তাঁর কবিতার স্বাদ আস্বাদনকারী সমঝদারের সংখ্যা সম্ভবত পৃথিবীর যেকোনো কবির চেয়ে অনেক বেশি। পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনো কাব্য এত অল্প সময়ে এত অধিক জনপ্রিয়তার রেকর্ড গড়ে নি। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন অঞ্চলে তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর চিন্তা-চেতনা-দর্শন।
সুফিসাধক ও জ্যোতির্বিদ খৈয়্যাম যে রুবাইয়াৎ বা রুবাঈ এর কারণে খ্যাত সেই রুবাইয়াৎ বা রুবাঈ এর সংজ্ঞায় এ টি এম মোস্তফা কামাল লিখেছেন: ‘রুবাই আরবী শব্দ। অর্থ-চতুষ্পদী অর্থাৎ চার পংক্তি বিশিষ্ট কবিতা। এটা বিশেষ ধরণের কবিতা। কিছু কিছু কবিতা আছে বিশেষ কিছু নিয়ম কানুন মেনে সেগুলো লেখা হয়, যেমন- সনেট, লিমেরিক, এলিজি,ওড, ক্বাসিদা, রুবাই ইত্যাদি। রুবাইয়ের বহুবচন রুবাইয়াত। ১০৪৮ খ্রিষ্টাব্দে পারস্যের (বর্তমান ইরান) কবি উমর খৈয়াম, হাফিজ প্রমুখের হাতে কবিতার এই বিশেষ ফর্মটি চরম উৎকর্ষ লাভ করে। এটি ছড়া নয়। ছড়া হচ্ছে মূলত: শিশুতোষ রচনা। রুবাই উচ্চমার্গের দার্শনিক রচনা। সুফিবাদ ও মুতাজিলা সম্প্রদায়ের দার্শনিক মতের সঙ্গে মিল পাবেন রুবাইয়ের দর্শনের।’
প্রধানত সুফিবাদী দর্শন দ্বারা প্রভাবিত এই সব রুবাই মাত্র চার লাইনে লেখা হয়েছে। রুবাইয়ে উল্লিখিত সাকি সুরা প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে সাকি হলো মুর্শিদ আর সুরা হচ্ছে দিব্যজ্ঞান/পথের দিশা। রোমান্টিকতাও যে তাতে নেই তাও নয়। এতে প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ লাইনে একই অন্তমিল রাখা হয় তৃতীয় লাইনটি মুক্ত অর্থাৎ কোন অন্তমিল থাকেনা (ককখক)।
বাংলা ভাষায় রুবাইয়াত এর অনুবাদ অনেক সাহিত্যরস বোদ্ধা ও বিশ্ব সাহিত্যের প্রেমিক চমৎকার ভাবে করেছেন। তন্মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম, ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ,সত্যেন্দ্র নাথ দত্ত, কান্তিচন্দ্র ঘোষ, বিমল চন্দ্র ঘোষ, নরেন্দ্র দেব, সিকান্দার আবু জাফরসহ এ পর্যন্ত ১০৪ জন গুণী বাংলা ভাষায় রুবাইয়াৎ অনুবাদ করেছেন৷ তার মধ্যে কাজী নজরুল ইসলামের অনুবাদ বিশেষ প্রণিধানযোগ্য৷
খৈয়ামের অনুবাদ হয়েছে তিন শ্রেনীতে প্রথমত ভাবমুখ্য, দ্বিতীয়ত গতিমূখ্য, তৃতীয়ত ভাব-গতি মূখ্য। কাজী নজরুল ইসলাম অনুবাদে তৃতীয় লক্ষণটি স্বরূপে বিরাজমান ৷ কাজী নজরুল ব্যতিত এই অনুবাদকগণ ফার্সী ভাষা জানতেন কিনা তা সহজে বোধগম্য নয়৷ যদিও জেনে থাকতে পারেন তবে বলতে হয় ইংরেজ কবি ফিটজেরাল্ডের মোহ তারা পূর্ণরুপে কেটে উঠতে পারেন নি।
নজরুল কিভাবে রুবাইয়াৎ-ই ওমর খৈয়্যামের প্রতি আকৃষ্ট হলেন তা নজরুলের ফারসি শেখা ও ফারসি প্রীতি দেখলে বোধগম্য হবে। শৈশবে বেনেপাড়ার বিনোদ চাটুজ্জের পাঠশালায় কিছুদিন পড়ে নজরুল গ্রামের মক্তবে লেখাপড়া শুরু করেন। এখানে তিনি কোরআন পাঠ আয়ত্ত করেন। মক্তবে তিনি আরবি ও ফারসি ভাষার প্রথম পাঠ লাভ করেছিলেন মৌলবি কাজী ফজলে আলীর কাছে। পরে বিশেষ করে ফারসি শেখেন তাঁর চাচা কাজী বজলে করিমের (নজরুলের পিতামহ কাজী আমিনুল্লাহর কনিষ্ঠ ভ্রাতা কাজী নাজিবুল্লাহর পুত্র) কাছে।
তাঁর ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আগ্রহের কথা তিনি নিজেই ‘রুবাইয়াত-ই হাফিজ’র ভূমিকায় লিখেছেন, “আমাদের বাঙালি পল্টনে একজন পাঞ্জাবি মৌলবি সাহেব থাকতেন। একদিন তিনি দীওয়ান-ই-হাফিজ থেকে কতকগুলি কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। শুনে আমি এমনই মুগ্ধ হয়ে যাই যে, সেইদিন থেকেই তাঁর কাছে ফারসি ভাষা শিখতে আরম্ভ করি।
তাঁরই কাছে ক্রমে ফারসি কবিদের প্রায় সমস্ত বিখ্যাত কাব্যই পড়ে ফেলি।”
এছাড়াও নজরুলের আরবি ও ফারসি বিষয়ে পান্ডিত্য সম্পর্কে সদালাপ ডট অর্গ এ বর্ণনা করা হয়েছে, ” একাধিক আরবী-ছন্দ নিয়ে নজরুলের অসংখ্য কবিতা আছে, বাংলা ভাষার আরও এক প্রতিভাবান কবি ফররুখ আহমদ এ বিষয়ে কারিশমা দেখাতে পারেনি।
ইরানের কবি হাফিজ আর ওমর খৈয়ামের যতজন ‘কবি’ অনুবাদক আছেন তার মধ্যে নজরুল একমাত্র মূল ফারসি থেকে অনুবাদ করেছেন, বাকী সবাই ইংরেজীর থেকে।
“ফারসি” এবং “আররি”তে নজরুল এর জ্ঞান ছিল পাণ্ডিত্যের পর্যায়ে।”
নজরুলের অনুবাদ যে অন্য ১০৩ জন অনুবাদকের অনুবাদ থেকে শ্রেষ্ঠ তা আমরা একটা তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে জানব। তুলনামূলক আলোচনার শুরুতে ফিটজেরাল্ডের অনূদিত রুবাইয়াৎ তুলে ধরছি ও তারপর সেই রুবাইয়াৎ এর অনুবাদগুলি ক্রমান্বয়ে তুলে ধরছি।
ফিটজেরাল্ডের অনুবাদ:
‘Tis all a Chequer-board of Nights and Days
Where Destiny with Men for Pieces plays:
Hither and thither moves, and mates, and slays,
And one by one back in the Closet lays.’
কান্তি ঘোষের অনুবাদ:
ছকটি আঁকা সৃজন ঘরের
রাত্রী দিবা দুই রঙের,
নিয়ৎ দেবী খেলছে পাশা
মানুষ ঘুঁটি সব ঢঙের;
প’ড়ছে পাশা ধ’রছে পুনঃ,
কাটছে ঘুঁটি, উঠছে ফের—
বাক্সবন্দী সব পুনরায়,
সাঙ্গ হ’লে খেলার জের ৷
সিকান্দার আবু জাফরের অনুবাদ:
দিন-রাত্রীর রঙ দিয়ে আঁকা দাবার ছকটি মেলে
নসীব খেলছে বিচিত্র খেলা মানুষের ঘুঁটি চেলে;
ঘর থেকে ঘরে চালে চালে ঘুঁটি পড়ছে মরছে আর
দান শেষ হলে আবার তাদের বাক্সে রাখছে ঢেলে ৷৷
যেখানে মূল ফারসির বঙ্গানুবাদটি হচ্ছে,
আমরা খেলনা আর আসমান খেলোয়ার—বাস্তবে দেখ কল্পনায় নয় ৷কিছুটা সময় এর মধ্যে দেওয়া-নেওয়ার খেলা করে—সিন্দুকে মানুষকে একে একে পুরে রাখে ৷
কাজী নজরুলের অনুবাদ:
আমরা দাবার খেলার ঘুঁটি, নাইরে এতে সন্দ নাই!
আসমানী সেই রাজ-দাবাড়ে চালায় যেমন চলছি তাই ৷
এই জীবনের দাবার ছকে সামনে পিছে ছুটছি সব
খেলা শেষে তুলে মোদের রাখবে মৃত্যু-বাক্সে ভাই!
অনুবাদগুলো পর্যালোচনা করলে ফিটজেরাল্ডের অনুবাদের অতিরঞ্জিত কবি প্রতিভার লক্ষণ পাওয়া যায় ৷ আর বাংলা অনুবাদে তার আরেক রূপ পরিলক্ষিত হয় ৷ কান্তিচন্দ্র ঘোষ ফিটজেরাল্ডের সবটুকুই নিয়েছেন সিকান্দার আবু জাফরের মত তবু কবি কল্পনায় বিস্তর ফারাক ৷ অন্যদিকে কাজী নজরুল ইসলামের রুবাইয়াৎ আরবি ঘোড়ার তেজে চলেছে নিখূঁত ছন্দে কেননা ফারসি ভাষা আয়ত্তে থাকার ফলে মূলভাব তার আত্নগত ছিল।
আসুন আরেকটি পর্যালোচনা করি!
ফিডজেরাল্ডের অনূদিত রুবাইয়াৎ:
“How sweet is mortal Sovranty!”—think some:
Others—”How blest the Paradise to come!” Ah, take the Cash in hand and waive the Rest;
Oh, the brave Music of a distant Drum!
কান্তি ঘোষের অনুবাদ:
রাজ্যসুখের আশায় বৃথা
কেওবা কাটায় বরষা মাস;
স্বর্গসুখের কল্পনাতে
পড়ছে কারুর দীর্ঘশ্বাস ৷
নগদ যা’পাও হাত পেতে নাও,
বাকীর খাতায় শূন্য থাক্ ―
দূরের বাদ্য লাভ কি শুনে? ―
মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক ৷
যেখানে নজরুলের অনুবাদ:
করছে ওরা প্রচার―পাবি স্বর্গে গিয়ে হুর পরী,
আমার স্বর্গ এই মদিরা, হাতের কাছের সুন্দরী৷
নগদা যা পা’স তাই ধরে থাক, ধারের পণ্য করিসনে,
দূরের বাদ্য মধুর শোনায় শুন্য হাওয়ায় সঞ্চরী ৷
মূল ফারসির বাংলা ভাষান্তর হলো:
সকলে বলে বেহেস্তের আনন্দ হুরপরীতে―আমি বলি আমার আনন্দ দ্রাক্ষারসে ৷ বাকী মুল্যের জন্য নগদ হাতছাড়া কর না―দূরের খুশির বাদ্য তীব্রই শোনায়।
ফিডজেরাল্ড, কান্তি ঘোষ ও নজরুলের অনুবাদের মধ্যে ভাব, রস, শব্দ চয়ন ও রুবাইয়াৎ এর দেহ সৌষ্ঠব গঠণে নজরুল শ্রেয়।
‘A Book of Verse underneath the bough,
A jug of wine, a book of verse and thou
Beside me singing in the wilderness
Oh, wilderness were paradise enow!’
( Edward Fitzgerald)
চুমুকখানি লাল মদিরা আর গজলের একটি কিতাব,
জান বাঁচাতে দরকার মতো একটু খানি রুটি কাবাব,
তোমায় আমায় দুজনেতে বসে প্রিয়ে নির্জনেতে
এ সুখ ছেড়ে রাজ্য পেলেও কিছুতেই বলব না লাভ।
( মুহম্মদ শহিদুল্লাহ)
এক সোরাহি সুরা দিও, একটু রুটির ছিলকে আর,
প্রিয় সাকি, তাহার সাথে এক খানা বই কবিতার,
জীর্ণ আমার জীবন জুড়ে রইবে প্রিয়া আমার সাথে,
এই যদি পাই চাইব না তাখত আমি শাহানশার।
( কাজী নজরুল ইসলাম)
উপর্যুক্ত তিনটি অনুবাদ পড়লে নজরুলের অনুবাদটিকে এককথায় অসাধারণ বলতে হয়। যেখানে ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর অনুবাদটি নজরুলের অনুবাদের কাছে মৌলিকতায় খাটো।
নরেন্দ্র দেব-এর একটি অনুবাদ:
ঐ আকাশের গ্রহ তারার ভীড়ের মধ্যে যেদিন যাবো
এমন স্নিগ্ধ শস্য শ্যমল জগৎ কি আর সেথায় পাবো!
হায় ধরণী- হৃদয় রানী তোমায় ফেলে যেতেই হবে
মনটা আমার কাঁদছে গো আজ সেই বিরহের অনুভবে।
নরেন্দ্র দেবের অনুবাদে বিচিত্র ছন্দের প্রভাবে শ্রুতিজনিত সমস্যা কিছুটা উপলব্ধি হয় আর রুবাইয়াৎ এর অস্বাভাবিক আকার বৃদ্ধি অনেককেই তুষ্ট করতে পারে নি ৷
খৈয়ামের ফারসি রুবাইয়াতের অনুবাদগুলো বাংলায় অবিকল বিষয়বস্তুতে আসেনি ৷ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বক্তব্য হল ফারসি থেকে অনুবাদ আর ইংরেজি থেকে অনুবাদ; এই দুই শ্রেণি সম্পর্ণ আলাদা ৷
যেমন অনিন্দ এর The quartains of Omar Khayyam –
by E.H.Whinefield থেকে করা ।
ওমর খৈয়াম এর রুবাইয়াৎ:
ভালোবাসাকেই চাইছো যখন খোঁজ সবার অন্তরে,
খুঁজে পেলে তাকে সযত্নে রেখো হৃদয় অভ্যন্তরে ;
শত ক্বাবাতেও সমান হবে না এক হৃদয়ের প্রাপ্তি,
ক্বাবা নয় ,খুঁজো ভালোবাসাকেই আপণ হৃদয় মন্দিরে ।
সত্যেন্দ্র নাথ দত্তের অনূদিত একটি রুবাইয়াৎ পড়লে আমরা নজরুলের অনুবাদ কেমন তা উপলব্ধি করব।
সত্যেন্দ্র নাথ দত্তের অনুবাদ:
প্রথম মাটিতে গড়া হয়ে গেছে শেষ মানুষের কায়
শেষ নবান্ন হবে যে ধান্যে তারো বীজ আছে তায়
সৃষ্টির সেই আদিম প্রভাতে লিখে রেখে গেছে তায়
বিচার কর্ত্রী প্রলয় রাত্রি পাঠ যা করিবে ভাই।
কান্তি ঘোষের একটি অনুবাদ পড়ে নিতে পারি।
সেই নিরালা পাতায় ঘেরা বনের ধারে শীতল ছায়
খাদ্য কিছু পেয়ালা হাতে ছন্দ গেঁথে দিনটা যায়
মৌন ভাঙ্গি মোর পাশেতে গুঞ্জে তব মঞ্জু সুর
সেই তো সখি স্বপ্ন আমার সেই বনানী স্বর্গপুর ।
একপ্রয়াশে নজরুলের ভাষান্তরিত কয়েকটা রুবাইয়াৎ পড়ে নেই।
১৪ নং রুবাইয়াৎ:
আত্মা আমার! খুলতে যদি পারতিস এই অস্থিমাস
মুক্ত পাখায় দেব্তা-সম পালিয়ে যেতিস দূর আকাশ।
লজ্জা কি তোর হল না রে, ছেড়ে তোর ওই জ্যোতির্লোক
ভিনদেশি-প্রায় বাস করতে এলি ধরায় এই আবাস?
১৯নং রুবাইয়াৎটি:
সাকি! আনো আমার হাতে মদ-পেয়ালা, ধরতে দাও!
প্রিয়ার মতন ও মদ-মদির সুরত-ওয়ালি ধরতে দাও!
জ্ঞানী এবং অজ্ঞানীরে বেঁধে যা দেয় গাঁট-ছড়ায়,
সেই শরাবের শিকল, সাকি, আমায় খালি পরতে দাও।
৪০ নং রুবাইয়াৎ:
ছেড়ে দে তুই নীরস বাজে দর্শন আর শাস্ত্রপাঠ,
তার চেয়ে তুই দর্শন কর প্রিয়ার বিনোদ বেণির ঠাট;
ওই সোরাহির হৃদয়-রুধির নিষ্কাশিয়া পাত্রে ঢাল,
কে জানে তোর রুধির পিয়ে কখন মৃত্যু হয় লোপাট।
উপর্যুক্ত পর্যালোচনা ছাড়াও জ্ঞান বিদগ্ধ সাহিত্য সমালোচকগণের মূল্যায়নগুলি যদি আমরা দেখি তাহলে দেখতে পাই যে, সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন,“ওমরই ওমরের সর্বশ্রেষ্ঠ মল্লিনাথ, কাজীর অনুবাদ সকল অনুবাদের কাজী।”
বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেছেন, “রুবায়াৎ-ই ওমর খৈয়াম নজরুলের আগে দু’একজন অনুবাদ করেছেন কিন্তু সে সবের আর অস্তিত্ব নেই। তাঁর মতো অতো সাবলিল ও হৃদয়গ্রাহী করে আর কেউ অনুবাদ করতে পারেননি। যে কারণে নজরুলের এই অনুবাদিত গ্রন্থটি শতশত বছর পরেও পাঠক মহলে সমাদৃত হবে।”
অবশ্যি কান্তি ঘোষের অনুবাদের খুব প্রশংসা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি বলেছিলেন কান্তি ঘোষকে-
“কবিতা লাজুক বঁধুর মতো এক এক ভাষার অন্তঃপুর থেকে অন্য ভাষার অন্তঃপুরে আনতে গেলে আড়ষ্ট হয়ে যায়। তোমার তর্জমায় তুমি তার লজ্জা ভেঙ্গেচ, তার ঘোমটার ভিতর থেকে হাসি দেখা যাচ্ছে”।
নজরুল যে অনুবাদ সাহিত্যের মহান কারিগর তার প্রমাণ দিয়েছেন ফারসি ভাষায় লেখা রুবাইয়াৎ-ই ওমর খৈয়াম বাংলায় অনুবাদ করার মধ্য দিয়ে। আজ থেকে ৯০ বছর আগে পারস্য ঔপন্যাসিক ওমর খৈয়ামের অমর গ্রন্থ রুবাইয়াৎ-ই ওমর খৈয়াম প্রথম অনুবাদ করেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯৩৫ সালে অনুবাদিত এই বইটি প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকে। দ্বিতীয় সংস্করণও প্রকাশ হয় ১৯৫৮ সালে কলকাতা থেকে। তখন বইটির চিত্রায়ণ করেছিলেন খালেদ চৌধুরী, ভূমিকা লিখেছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী।
বইটি প্রথম প্রকাশ হওয়ার পর অসাধারণ অনুবাদের জন্য উপমহাদেশের পাঠকদের মধ্যে তুমুল আলোড়ন তুলে। বাংলাভাষার মহান এই কবি যে ফারসি ভাষায়ও সিদ্ধহস্ত ছিলেন তার প্রমাণও দিয়েছেন। তাঁর অনুবাদ যে বাঙলায়নকৃত সকল অনুবাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দীর্ঘ ৯০ বছর পর সেটাই প্রমাণ হচ্ছে।
মীম মিজান : লেখক, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক