শনিবারের ছড়া—সময়ের চলচ্চিত্র

বাইরে যতই শান্ত সুবোধ দেখাক না ভাই তাকে
লড়াই দিয়েই চিনতে পারি বাঙালি জাতটাকে।
২০১৮সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২০-র আগস্ট মাস পর্যন্ত ‘শনিবারের ছড়া’ শিরোনামে মোট ১০২টি ছড়া ফেসবুকে পোস্ট করেন স্বনামধন্য কবি ও ছড়াকার প্রবীর ঘোষ রায়। ওপরের দুটি লাইন হ’ল একদম প্রথম ছড়ার শুরুর দু’লাইন। তখনই বাঁধা হয়ে যায় কবি যা লিখতে চলেছেন তার মূল সুরটি। বাঙালি-অস্মিতা, বাঙালির ভাষা, শিল্প, সংস্কৃতি, লোকাচার সমস্ত কিছুর ওপর যে আঘাত সুপরিকল্পিতভাবে নামিয়ে আনা হচ্ছে, যেভাবে স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা গ্রাস ক’রতে চাইছে বাংলা তথা ভারতবর্ষের বহুত্ববাদ, তারই প্রতিবাদের ভাষ্য এই ছড়া সংকলন।
এর আগে প্রবীর ঘোষ রায়ের আরেকটি ছড়ার বই ‘ছড়ার ছড়ি’-র মুখবন্ধকার লিখেছিলেন ‘সাহস না থাকলে অমন তীক্ষ্ণ শ্লেষ আসে না, আগুন না থাকলে অমন আলো উৎসারিত হয় না’। বর্তমান সংকলনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এই বইয়ের ছড়াগুলো গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে দাপিয়ে বেড়ানো একনায়কের বিরুদ্ধে, সবার সঙ্গে থেকে সবার বিকাশ ঘটানোর ঝুটো স্লোগানের আড়ালে ঘটতে থাকা নিষ্ঠুর গোষ্ঠীতন্ত্রের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদের ভাষা জোগাবে সাধারণ মানুষের মুখে। সাহিত্য সংস্কৃতির প্রসার ঘটাতে লেখক বলিষ্ঠ উদ্যোগ নিয়েছেন। ছড়াকার ও কবি প্রবীর ঘোষ রায়কে কুর্নিশ। কোনো প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। পাঠক সমৃদ্ধ হবেন।
‘রামরহিমের ব্যারিকেডে বন্ধু-দোস্তো মেলায় হাত’ বা ‘বন্ধুরা হাত ধরো বন্ধুর সড়কে / গোলাভরা ধান থাক, কাজ নাই মড়কে’ এইসব উচ্চারণ ভয়ংকর বিভেদকামী শক্তিকে শক্ত হাতে প্রতিরোধের শপথের মতো জেগে থাকে।
মূলত সমাজ, রাজনীতি বা অর্থনীতি-সচেতন কবিতাগুলির সঙ্গে স্থান পেয়েছে কিছু শিশু-কিশোরদের মন ভালো করার মতো ছড়া, আবার কিছু প্রেমের শব্দবন্ধনও। যেমন ছোটদের জন্য লেখা ইছামতিকে নিয়ে ছড়া বা আষাঢ়ের প্রথম দিনে লেখা ‘বাতাসে ভেসে আসা ক্লান্ত জলকণা/ তোমাকে ছুঁয়ে এসে আমাকে খোঁজে/ বিরহী আষাঢ়ের প্রথম দিবসে/ সেও কি কবি, সেও প্রেম বোঝে?’
দু’বছর ধরে ঘটে চলা ভারতবর্ষীয় রাজনীতির নানান অভিঘাত এই বইটির দুই মলাটে ছড়ার ছন্দে ধরা আছে। আছে বহু কোটির মূর্তি-স্থাপন, পুলওয়ামা, নেতাদের দলবদল, জাল সার্টিফিকেট, অবৈজ্ঞানিক ভাষণ, করোনা-অতিমারি সমস্ত বিষয়কেই ছুঁয়ে গেছে এই বই। প্রতিটি ছড়ার প্রস্তাব থেকে রচনার প্রেক্ষিত খানিকটা ধরা পড়ে।
বইটির প্রচ্ছদ সায়র ঘোষ রায়ের করা। দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদটি প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করবে পাঠকের।
এই সংকলনের একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু সুলিখিত কথামুখ রয়েছে ইমানুল হকের কলমে। তাঁর কথায় ‘আমাদের সময়কে ব্যাখ্যা করতে প্রবীর ঘোষ রায়ের কলম উদ্যত তীক্ষ্ণ তরবারি।জয় হোক ছড়ার, জয় হোক শিল্প-ছড়ির’।
এই ছড়াগুলো রচনার কিছু সময় পরে রাজধানী ঘিরে শুরু হয় ঐতিহাসিক কৃষক-বিদ্রোহ, শেষ-পাতে শীর্ষক সংযোজনে এবং শেষ মলাটে সে কথাও লিখেছেন কবি:
‘ভুলো না শাসক, জওয়ান কিন্তুচাষীর ঘরেরই ছেলে,
কী হবে হঠাৎ তোমার দিকেই
নিশানাটা ঘুরে গেলে!’
শনিবারের ছড়া,
প্রবীর ঘোষ রায়,
দেশ প্রকাশন, ৬, ডালিমতলা লেন, কলকাতা-৭০০০০৬, মূল্য ২০০টাকা।
ফারুক আহমেদ : সম্পাদক, উদার আকাশ, কলকাতা, ভারত।