অমর মিত্রের ‘একটি গ্রাম একটি নদী’

অমর মিত্র। বাংলা সাহিতের এক উজ্জ্বল নাম। তিনি এক সাহিত্য সভায় এক লেখক বন্ধু বলেছিলেন, তাঁর একটি নিজস্ব ভূখণ্ড আছে, একটি গ্রাম আছে, একটি নদী আছে। তিনি তাই নিয়ে লেখেন। শ্রোতা ছিলেন যিনি, তাঁর বুকের ভিতরে গিয়ে বাক্যটি ঘা মেরেছিল। তিনি লিখতে চান। তাহলে তাঁর লেখা হবে না ? তাঁর তো নিজস্ব গ্রাম নেই, যে গ্রামে তাঁর পিতৃপুরুষের পায়ের চিহ্ন পড়ে আছে, তাঁর তো নিজস্ব কোনো নদী নেই, ছিল কিন্তু তা ছেড়ে এসেছেন তিনি। সীমান্তের ওপারে পড়ে আছে তা। গ্রামের নাম বহু উচ্চারিত ধূলিহর, নদীর নাম বেতনা আর কপোতাক্ষ।
তাঁর লেখক বন্ধুর সেই উচ্চারণই এই উপন্যাসের বীজ। এই উপন্যাসের মূল চরিত্র বিল্বমঙ্গল জানে তার দেশ আর তার দেশ নেই। তার পিতৃপুরুষ নিজ গ্রাম নিজ নদী ছেড়ে এপারে চলে এসেছিল। দেশ যদি বদল হয়ে যায়, নদী আর গ্রাম নিজের থাকে কীভাবে ? এই উপলব্ধিই উপন্যাসটির মূল সুর। কিন্তু বিল্বমঙ্গলের বিপরীতে অতি দরিদ্র গোলাম বলে, নিজের গ্রাম নিজের নদী থাকলে হাতি ঘোড়া কিছুই লাভ হয় না, তারই তো গ্রাম আছে আঁধারকুলি, তারই নদী আছে, দামোদর, সে সব ছেড়ে কলকাতায় ঠাঁই করবে ভাবছে। ওখানে থেকে তার কিছুই হবে না। জীবনের নানা দ্বান্দ্বিকতায় পরিপূর্ণ এই উপন্যাস। এই উপন্যাসে এমন এক গ্রাম আছে, যে গ্রামে ঘরে ঘরে কবি, পঞ্চায়েত কবি সভা ডাকে মাসে একবার। এমন এক গ্রাম আছে যেখানে রাত্তিরে ঠাকুর বংশীধর মুরলী বাজিয়ে ঘোরেন। গৃহ বধূরা সেই মুরলী ধ্বনিতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। জীবনের যাদু আর স্বপ্নের ঘোরে উপন্যাসের চরিত্ররা ঘোরে ফেরে, ভালোবাসে, প্রত্যাখ্যাত হয়। জীবনের অনন্য স্বাদে পরিপূর্ণ হয়।
উপন্যাসের শুরুর অংশ
এই যে আমার অফিস। আমার অফিস, দেবাংশুর অফিস, ইলিনার অফিস। আমাদের অফিস। সেই কবে চাকরিতে ঢুকেছিলাম, মনে হয় আগের জন্মে। এই যে সেই অফিস, কত বড় বাড়ি, ব্লকের পর ব্লক। কত কত ডিপার্টমেন্ট। জেলা সদর। কলকাতার গায়ে। আসলে এই জেলাটি কলকাতার মধ্যেও ঢুকে পড়েছে অনেকটা। এখানে আমি বাইশ বছর চাকরি করেছি। তার আগে করেছি বাঁকুড়া জেলায়। তার আগে বর্ধমানে। তারপর এখানে এসে আর কোথাও যেতে হয়নি। আমার চাকরি প্রায় শেষ হয়ে এল। আর এক বছরও নেই। আমি দেবাংশুকে বললাম, কবে যাবে দেবাংশু?