গ্রন্থিল

অলংকরণ : নিয়াজ চৌধুরী তুলি
তমাল বাড়িটি খুঁজে রেখেছিল আগেই। বিয়ের পরে নিজের বলে একটি আস্তানা থাকা অতিব জরুরি। উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে যাযাবর জীবনের অনেকটা সময় তো পার করেই দিয়েছে। এখন একটু থিতু হবার সময়। জীবনের আরও এক ধাপ পূরণের সময়। যেখানে নিজের বলে ভাববার বিষয় বস্তু থাকে অনেক। আনন্দের সাথে শেয়ারিং কেয়ারিং জড়াজড়ি করে চলে। তমালের এক বন্ধুর বাবার বেশ অনেকগুলো অ্যাপার্টমেন্ট আছে ভাড়ায় চলে ওরই মধ্যে একটায় কিছুটা সাশ্রয়ে তমাল পেয়ে যায় অ্যাপার্টমেন্ট আজিমপুরে।এই শহরে আপন বলতে কেউ নেই তমালের। ব্যাচেলর জীবনের বন্ধু বান্ধবরাই তার আপন আত্মার আত্মীয় স্বজন। তারাই তার পরিবারের সদস্য। সুখে দুঃখে আনন্দে বেদনার সঙ্গী। আর ছন্দা নামের মেয়েটি আজ যে তার ঘরনী। যাকে নিয়ে আজ তার এই গৃহে প্রবেশ। তার বাড়িটিও নয়াপল্টনে। নয়াপল্টনেই ওদের আড্ডা স্থল। নয়াপল্টন, পুরানা পল্টন, ফকিরাপুল, শান্তিনগর, মতিঝিল, চামেলিবাগ, মালিবাগ, আর আজিমপুরের ছেলেদের সঙ্গে ওঠা বসা ছিল এবং পল্টনেই তমালদের আড্ডা স্থল। মুক্তিযুদ্ধের সময় ওরাই পথের সাথী-মতের সাথী – গন্তব্যের সঙ্গী। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি।
ছন্দা তমালের ছোট্ট সংসার। শুরুতে অল্প ভাড়ার বাসায় থিতু হতে চায়। যে বাসা পেয়েছে ঐ বাসাতে উঠে বিয়ের পরে তমাল ছন্দা। যদিও ওরা দুজনই অল্পে তুষ্ট মানুষ। অল্পেই গুছিয়ে চলতে জানে। কিন্তু ছন্দা গৃহে প্রবেশ করে হোঁচট খায়। মুখ দিয়ে কিছু কথা বেরিয়ে আসে – আর কোথায়ও কি বাড়ি পাওয়া যায়নি ? এখানেই নিতে হলো? বলে নিজেকে সামলে নিয়ে তমালের পায়ে পায়ে প্রতিটি রুম ঘুরে ঘুরে দেখলো। তমালের বুকের ভেতরে খচখচ করছে কাঁটার মত কথাগুলো। কিসের অশনিসংকেত ? ছন্দার মনের দিশা কি তমাল বুঝতে পেরেছে। স্থান নির্বাচনে তমাল কি ভুল করেছে। কেন ওর মাথায় আসেনি ছন্দার মতামত নেয়া প্রয়োজন। এক তরফা ভাবে কাজটি করে ফেলা ওর উচিত হয়নি। ছন্দার কথায় তমালের বিস্মৃত অতীত সামনে এসে দাঁড়ায়। এরই মাঝে কি ভাবে ভুলে গেছে তমাল, ছন্দার বিষদময় স্মৃতি জড়ানো এই আজিমপুর। সেখানটায় ওরা দুজনই বহুবার এসেছে। চোখের জলে নাইয়ে দিয়েছে দুজন দুজনার স্মৃতি আশ্রম। তমালের দুচোখ ছন্দার মন পড়তে চায় কেবল ছন্দা তমালের চোখ থেকে পালিয়ে বেড়ায়। নিজের অজান্তে নিজেই একা পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখে। ডাইনিং স্পেস পেড়িয়ে বেড রুম আবার ডাইনিং স্পেস পেড়িয়ে রান্না ঘর। রান্না ঘরের পাশে বেলকনি গ্রীল দেয়া। কিন্তু ওখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায় গোরস্থান । চারিদিকে প্রচুর গাছগাছরা বেশ বড় বড় হয়ে গেছে। যত দূর চোখ যায় সারি সারি কবর। তার প্রিয় মানুষটি এই আজিমপুর কবরস্থানে শুয়ে আছে। প্রতি নিয়ত এই কথাটি ওকে স্মরণ করিয়ে দেবে। আর এখানে ছন্দা থাকবে তমালের সাথে ? ভাবতেই শিউরে ওঠে ছন্দা। সারাটা গা ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। পালিয়ে যাওয়ার মত করেই দৌড়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ারে বসে। স্থির হয়ে পানি খায়। তমাল ঘরের মালপত্র এদিক সেদিক সরাতে সরাতে ছন্দাকে দেখে আর বলে শরীর খারাপ লাগছে না তো ? ছন্দা বেশ আস্তেই জবাব দেয় – না । ভালো আছি, কিছু হয়নি।
ছন্দা নিজেকে গুটিয়ে রাখে নিজের ভেতরে শামুকের কঠিন বর্মের মত। তমাল ওর কাছ থেকে কিছুটা উচ্ছ্বাস আন্তরিকতাই আশা করেছিল। কিন্তু প্রথম কথাটি ভুলতে পারছে না তমাল। ছন্দার পছন্দ হয়নি এই লোকালয়টি । তমাল জানে বাড়িটির কোন দোষ নেই। পছন্দ না হবার কথাও নয়। এতো কম ভাড়া এমন বাড়ি পাওয়া ঢাকা শহরে ভীষণ দুষ্কর। ছন্দাও বোঝে ব্যাপারটা । কিন্তু চব্বিশটি ঘন্টা ওকে আরেক জনের মুখোমুখি হতে হবে। অবচেতন মনে হোক আর না চাইলেও হোক দিব্ব আঁখিতে সর্বদা তমালের পাশাপাশি মানিক এসে দাঁড়াবে । কেনো যে ছন্দার ভেতরে এই ব্যাপারটি তোড়পাড় করে চলেছে। না পারছে কইতে না পারছে সইতে। উভয় সংকটে । যা তা অবস্থা ছন্দার। ছন্দা বোঝে তমাল কম কষ্ট করেনি ওর জন্য। ওর সুস্থতার জন্য দুটো বছর রাত দিন এক করে দিয়েছে। যে নাই, তাকে আর পাবে না। তাকে মনের মাঝেই দাফন দিয়ে রেখেছে। যে আছে সামনে যার গায়ে মানিকের সুবাস লেগে আছে যে তাকে সারাটা সময় আগলে রেখেছে তাকে তো একটু ভালোবাসতেই পারে। তমালের জন্য মায়া হয় ছন্দার। মনে মনে অনুতপ্ত হয় কিন্তু কিছু বলতে ইচ্ছে হয় না ছন্দার। সাদামাটা দিন গড়িয়ে যায়। ছন্দা পরিস্কার করে কিছু বলে না। তমালও বুঝেও না বোঝার ভান করে। মৌচাকে ঢিল ছুঁড়তে চায় না। এভাবেই তিন চার দিন পার হয়ে যায় বিয়ের পরে জীবনটা এমন নিরামিষ হবে তমাল তা ভাবতেও পারেনি। এতো দিনে তমাল ছন্দা যে সম্পর্কে উতরে এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে তেমন উচ্ছ্বাস না থাকলেও আনন্দের এমন ভাটা পরবার কথা নয়। দুজনার সম্মতিতে বিয়ের কাজ সর্ম্পন্ন হয়েছে। তমাল কিছু জানতে চাইলে ছন্দা এড়িয়ে চলে কোন উত্তর দিতে চায় না। তমালও ভয়ে থাকে ছন্দাকে বেশি ঘাটতে চায় না। ছন্দার ঘর সংসারের নিত্য দিনের কাজ মুখ বন্ধ করেই চলেছে। তমালের খাওয়া দাওয়া দেখা শোনা সবই করছে কিন্তু আন্তরিকতার ভীষণ অভাব বোধ করছে। তমাল ছন্দাকে সময় দেয় আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে এই ভেবে। নতুন বিবাহিত জীবনে রোমান্টিকতা নেই বললেই চলে। নিজে নিজের মধ্যে থিতিয়ে আছে। আকাশে মেঘ যেমন থমথমিয়ে থাকে ঝড়ের পূর্ব আভাস তেমনি ছন্দার অবস্থা। এভাবে দিন গড়িয়ে পাঁচ দিন। তমালের আর ভালো লাগছে না। ওর সাথে আরও একটু খোলাখুলি কথা বলবে কি না ভাবছে তমাল। এর মধ্যে পাঁচ দিন প্রায় শেষ।
পাঁচদিনের রাত নিশি ডাকে ছন্দাকে। ছন্দা কি একটা ঘোরের মধ্যে। ঘুমের মধ্যে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে যায় ঐ রান্না ঘরের পাশের বারান্দাটিতে। নিজের অজান্তেই মাঝের দরজাটি খুলে নেয় গ্রীল দেয়া বারান্দার। কবরস্থানটি আলো আঁধারীতে মায়ামন্ত্র জালে ঘেরা। গাছপালাগুলো বাতাসের আঘাতে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে গায়ে গা ঘেষে মিহি শব্দ বিলিয়ে যাচ্ছে। তার ওপর পড়েছে লাইট পোষ্টের আলো । এর মধ্যে একজন ছায়ামানব ভীষণ লম্বা দেহ, দ্রুত গতিতে হাঁটছে আড় চোখে ছন্দার দিকে দৃষ্টি। আলো ছায়ায় ছন্দা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ওর দুটো চোখ। তীব্র চাহনিতে ওকেই দেখছে। ছন্দা, গ্রীলের ভেতর থেকে দুহাত বাড়ায় মুখে অস্পষ্ট উচ্চারণ মানিক ? লম্বা লম্বা পায়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। হাত দুটো দিয়ে আপ্রাণ চেষ্ঠা করে ছন্দা মানিককে ছুঁতে বহু বার । কিন্তু পারে না ছুঁতে। হঠাৎ দেখে ছায়ামানব ওর দৃষ্টি থেকে সরে যায়। ওর হাতে ধরা দেয় না। ছন্দা হাত বাড়িয়ে আবার ডাকে ডুকরে কেঁদে ওঠে। তমালের ঘুম ভেঙ্গে যায় ছন্দাকে বিছানায় পায় না। ঘরে ডিম লাইট কেবল জ্বলছিল। তমাল ডাইনিং রুমের লাইট জ্বালায়। ওর মনে হয় রান্না ঘরের পাশে সেই বেলকনিতে হয় তো ছন্দার গন্তব্য। সত্যি তাই। তমাল দ্রুত গতিতে পৌঁছে যায় বেলকনিতে। ছন্দাকে ডাকে তুমি এখানে? ওর দুই হাত গ্রীলের বাইরে। তমাল ভয় পেয়ে যায়। এ ভাবে ছন্দাকে দেখতে পাবে তা ভাবেনি তমাল। ছন্দা তমালের বুকে মুখ লুকায়। জোড়ে দুই বাহু দিয়ে তমালকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে বলে সে এসেছিল।
তমালের গা কেঁপে ওঠে। চারদিক নিঝুম নিশ্চুপ নিশুতি রাত। ওর মনে হচ্ছিল হয় তো সত্যি কেউ এখানে এসেছিল। মনের মধ্যে যদিও দ্বন্দ তবুও ছন্দাকে বুকে চেপে সাহস জোগায়। বলে ভয় পেয়েছ ? এ তো রাতে কেনো এলে এখানে?
ছন্দা কাঁদতে কাঁদতেই উত্তর দেয় – জানি না। আমি তো আসিনি। আমাকে নিয়ে এসেছে।
তমাল আর কথা বাড়াতে চায় না। যতটা চুপ থাকা যায় ততটাই মঙ্গল। ফ্রীজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করে গ্লাসে ঢেলে ছন্দার হাতে তুলে দেল। সাথে একটা ঘুমের ওষুধ। লক্ষী মেয়ের মত ওষুধটা খেয়ে শুয়ে পড়ে ছন্দা। তমালের দুচোখে আর ঘুম নেই। ছন্দার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। তমালের ঘুম বন্ধু মানিকের কাছে বন্দী হয়ে যায়। ঘরের লাইট না নিভিয়ে জ্বালিয়েই রাখে। বাকি রাতটুকু ভরসার স্থাল পাকা করে নেয়। ছন্দাকে কিছু মনে করিয়ে দিতে চায় না। সকালে ঘুম থেকে ওঠে ছন্দা। যথারীতি সংসারের কাজ কর্মে মন দেয়। কাল রাতের সব ঘটনা বেমালুম ভুলে যায় ছন্দা। মনে হয় কিছুই হয়নি কাল রাতে। টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে তমালকে দেয়। যা যা করণীয় সবই আপন গতিতে করে চলে। তমাল অফিসে যাবে একটু লেট করেই। হয় তো বা নাও যেতে পারে পল্টনের দিকেই বাসা খোঁজার ইচ্ছে নিয়ে মন ঠিক করে।
অনাবিল অখণ্ড অবসর ছন্দাকে তাড়া করে বেড়ায় স্মৃতির আঙিনায়। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে বেলকনিতে এসে দাঁড়ায়। গ্রীলের ফাঁকা দিয়ে দূর দূর দেখা যায় গোরস্থান। সবুজ গাছপালা গাঢ় ঘন ছায়াবিথী তার মাঝে বাঁধানো কবরগুলো দৃষ্টিতে উজ্জ্বল। কেবলই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মানিকের লাশ নিয়ে বন্ধুরা গোরস্থানে ঢুকছে। ছন্দা ভুলতে পারে না সেই দৃশ্য। কবরের জন্য মাটি খোড়া হচ্ছে। মানিকের লাশ দাফন করা হলো ওর চোখের সামনে। ওর মা বাবা বোনেরা বন্ধু আত্মীয় স্বজনেরা কাঁদছে। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ছন্দাও। গোরস্থানের নিরবতা বজায়ে রাখতে চিৎকার করে কান্নার উপায় ছিল না।
বুকের ভেতর ডুকরে একটা দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে আসে। এখন যেনো নিত্য দিনের রুটিন মাফিক কাজ। অফুরান সময় গোরস্থানের দিকে তাকিয়ে পার করে দেয়া যায় । তমাল সারা দিন অফিসে থাকে ছন্দার তেমন কাজ কর্ম নেই। কেবল স্মৃতির রাস্তায় হাঁটাহাঁটি ছুটোছুটি খেলা।
তমাল আজ অফিস থেকে দেরি করে ফিরে পল্টনে বাসা খুঁজতে গিয়েছিল। এই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ওর মন উঠে গেছে। ছন্দার মা বাবা বড় বোনের বাসার পাশেই খুঁজছে বাসা। তবুও ভালো নিশ্চিন্তে রাতের ঘুম তো হবে। প্রতিদিন গোরস্থান আর নতুন নতুন মানুষের দাফন তো দেখতে হবে না। এভাবে মানসিক ভারসাম্য হারাতে বসা ছন্দার জন্য জরুরি বাসা বদল। দিনটি ভীষণ ঝড় বাদলের আকাশে কালো মেঘের আনাঘোনা। ক্ষণে ক্ষণে ঝোড়ো হাওয়া বিকেল থেকেই। ঝড় বৃষ্টিতে ভিজেই তমাল বাড়ি ফেরে। আদা, গরম মসল্লার চা ছন্দা তার সামনে এনে ধরে। বলে এতো দেরি হলো যে? তমাল বলবে কি বলবে না ভেবে বলেই ফেলে পল্টনে তোমার মায়ের বাসার পাশে বাসা দেখতে গিয়েছিলাম, এই বাসাটা বদলাতে চাইছি। ঐ দিকটায় হলে তোমার নিঃসঙ্গতা কাটবে। মা বাবা বড় বোনদের কাছে পাবে। এ বাসাটা একটু দূর হয়ে গেছে। ছন্দা মিট মিট করে হাসে কি বলবে ভেবে পায় না। তবুও ঠোঁট নাড়ে। তমাল বলে কিছু বলবে ? হাসছো যে। না না এমনিতেই । মাত্র তো এলাম। এতো তাড়াতাড়ি বাসা বদল ? চুপ হয়ে যায় দুজনই। কারো মুখে কথা নেই সব কথা প্যাঁচ লেগে বসে আছে যার যার অনুভব অনুভূতির নাটাইয়ে। বেফাস কেউ কিছু বলতে নারাজ। ছন্দা চিন্তায় ডুবে যায় সেই আগের মতন। আজ আবার ওকে ঘুমের ওষুধ দিয়েই ঘুম পাড়াতে হবে। আজ রাতটা ভীষণ ঘুমের। ঘুমের মন্ত্র পড়ছে আকাশ। বিছানা আজ খুব বেশি করে আকর্ষণ করছে তমালকে। ছন্দার মনে কি চলছে সে ভালো জানে। তার ঘুম কেনো চুরি হয়ে গেছে বুঝে পায় না। ঘুমের ওষুধটা খেয়ে কিছুক্ষণ ঠিকই ঘুমিয়েছে। ছন্দাকে আগে থেকেই ডাক্তার ঘুমের ওষুধ দিতেন তাই তমাল যখন ওকে খেতে বলে তখন আপত্তি করে না খেয়ে নেয়। মনটা স্থির থাকে। একটু ঘুমের আমেজ আসে ভালোই লাগে।
না এলো না তেমন ভাবে ঘুম। ঘণ্টা দুই পরে জেগে যায় ছন্দা। নিশি ডাকে হ্যালোসিনেশনে ঘোর লাগা রাত। যাদুর ঝাপি খুলে বসে আছে। কত কথা। কত গল্পরা সারা ঘরময় ছুটোছুটি করছে। ওর চোখের সামনে পল্টনের রাস্তা। মানিক তার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। দূর থেকে ওকে দেখে। দোকানের পাশে গাছটির আড়ালে ছন্দা। মানিক আড্ডা ভেঙ্গে ছুটে আসে। কথারা প্রজাপতি রংধনু রঙিন ফানুস হয়ে করে ওড়াউড়ি। ঘরময় হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে আঁধার আর বিদ্যুতের আলোয় পথ চিনে নেয়। আর্কষণ সেই বেলকনি। ডাকে ওকে নিশিথিনী রান্না ঘর পেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে চেয়ার টেনে বসে। সে দিনের বেলাতেও এই কাজটি করে থাকে। আজানা আকর্ষণ ডানা মেলে। প্রচণ্ড বজ্রপাত ঝোড়ো হাওয়ার তাণ্ডব। গাছপালাদের নাচানাচি তুঙ্গে। বাইরে লাইট পোষ্টের আলো গাছপালার লুকোচুরি খেলায় আলো আঁধারীর রহস্যময় এক আবহ চৌহদ্দী জুড়ে। প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়ার দাপুটে বাতাস বারান্দার তাকে রাখা হাড়ি পাতিল আছড়ে ফেলে মেঝেতে। ছন্দার কিছুতেই কোন বৈকল্য নেই। গ্রীলের পাশে দুটো হাত প্রশারিত করে কাউকে ছুঁতে চায়। মৃদু আওয়াজে উচ্চারিত শব্দে কার সাথে আলাপ চারিতায়। বৃষ্টিতে ভিজে একাকার। আবার সেই লম্বা শরীরের ছায়ামানব ছন্দার সামনে দুটো হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে। দুজনার বৃষ্টি ভেজা শরীর। দুচোখে ভালোবাসার আগুন দাউদাউ জ্বলে তীব্র আর্তনাদে করে হাহাকার। প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়া বজ্র বিদ্যুতের চমক মেঘের গর্জন শো শো বাতাসের শব্দ চারদিকে ঝড়ের মহাউৎসব। দিব্বি দাঁড়িয়ে ওরা মায়ার মাঝে কায়ার অবস্থানে অন্তরঙ্গতায় মধুময় আচ্ছন্নতায়।
এদিকে তমালের ঘুম ভেঙে যায়। ঝড়ের তুমুল শব্দে।এ মাঝে অন্ধকারে চারদিক ভৌতিকতায় রূপান্তর। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের আলো পথ দেখায় । তমাল পাশে রাখা টর্চ লাইটটা হাতে তুলে নেয়। পাশে ছন্দাকে না পেয়ে বুঝে যায় সেই বেলকনিতেই তার অবস্থান। এমন আঁধারে প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়ার মাঝে খোলা বারান্দায় কি করছে। ওর সন্দেহ তীব্র হলো। পরি মারি করে ছুটলো টর্চে আলো জ্বেলে। ডাইনিং টেবিলে কোণে একটু আঘাত পেল। এ ভাবেই তড়িত বেগে ছুটে গিয়ে বারান্দায় পৌঁছে ভূত দেখার মত আতকে ওঠে তমাল। চিৎকার করে ডাকে ছন্দাকে। হাত বাড়িয়ে ছন্দাকে ধরতে যায়। ধরতে পারে না । ভীষণ লম্বা এক ছায়া মানব লম্বা দুটো হাত দিয়ে ছন্দাকে গ্রীলের ওপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে আছে। ছন্দা গ্রীলের সাথে মুখ লাগিয়ে কি যেনো বিড়বিড় করছে। টর্চের আলো পড়তেই ছায়াটা সরে যায়। মেঝেতে বৃষ্টির পানি হাড়িপালিত পড়ে থাকা বারান্দায় পিছলিয়ে পড়ে যায় তমাল। বুকের ভেতর ধরফর করে ওঠে। গা ছম ছম করে তমালের। তখনও বাইরে তুমুল ঝড়। ছন্দা ভিজে একাকার। সাহস করে ছন্দার কাছে পৌঁছে যায় তমাল। জড়িয়ে ধরে ছন্দাকে। নেই আতংকের ছাপ নির্বিকার চিত্তে তমালের কোলে নিজেকে সোপে দেয় ছন্দা। প্রায় অজ্ঞানের মত অবস্থায় তমাল ওকে অনেক কষ্টে বেড রুমে নিয়ে আসে। তখনও কি যেনো বিড়বিড় করেই চলেছে। তমাল জানতে চাইলো। কেনো গিয়েছিলে এতো রাতে ঝড় বাদলের মধ্যে। নেই কোন সাড়া। ছন্দা চোখ মেলে চায় কি যেনো খোঁজে ওর দুই চোখ। তমাল ভয় পেয়ে যায়। মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে দেয় বলে ভয় পেয়েছো ? কাকে খুঁজছো ? একটু বসতে চেষ্টা করো ভিজা কাপড় বদলে নেও। ছন্দা সম্বিত ফিরে পায়। দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে উঠে বসে। এরই মধ্যে ইলেক্ট্রিসিটি চলে আসে। চারিদিক আলোকিত। নিজেকে এই অবস্থায় দেখে একটু লজ্জানত হয় মাথা। উঠে দাঁড়ায় বলে কাপড় বদলে আসি। কাপড় বদলাতে বদলাতে নিজেকে স্থির করে নেয়। আমি কোথায় ছিলাম ? মানিকের কাছে ? ঐ বারান্দায় ? সত্যি তো মানিক এসেছিল। ভাবতে ভাবতে তমালের সামনে এসে যায়। তমাল জানতে চায় আজ কি ঘুমের ওষুধ খাওনি। ঘাড় কাত করে উত্তর দেয় খেয়েছি। ঘুম আসেনি। তমাল তবুও আবার একটা ঘুমের ওষুধ দেয়। পানি দেয় ছন্দাকে বলে লক্ষী মেয়ের মত খেয়ে ঘুমিয়ে পর। তমালও কথা বাড়ায় না ছন্দাও কিছু বলে না। দুজন দুজনের স্মৃতির মাঝে হারিয়ে যায়। ঘুমের প্রস্তুতি নেয়।
সকালে তমাল ওঠার আগেই ছন্দা উঠে পরে ঘুম থেকে। সে মহাব্যস্ত। তমাল উঠে দেখে টেবিলে তার নাস্তা রেডি। ঘর কন্যার কাজে নিজেকে এমন ভাবে ব্যস্ত রেখেছে ছন্দা। কিছু বলার অবকাশ নেই। এমনই ভাবলেশহীন চাহনী যে কাল রাতে কিছুই ঘটেনি। এটা কি করে সম্ভব তমাল ভাবে। গোরস্থানের পাশে এ বাড়িতে ওঠার পর থেকে ছন্দার পরিবর্তন তমালকে ভীষণ নাড়া দেয়। ছন্দার নির্লিপÍতায় তমাল পারে না ছন্দার সাথে কিছু শেয়ার করতে । আজ কেবলই ভেসে ওঠে রাতের সেই ছবি লম্বা কালো হাত ছন্দাকে অক্টোপাসের মত জড়িয়ে আছে। বিস্মৃত অতীত চোখের তারায় রহস্যময়তা ছড়ায়।
অগত্যা ছন্দার দেয়া নাস্তা খেয়ে অফিসের জন্য বেরিয়ে পরে। আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে হয় না। আজ কিসের অফিস ? আজ কেবল একটাই কাজ বাসা খোঁজা। যে করেই হোক বাসা খুঁজে পেতেই হবে। তমাল মরিয়া হয়ে ওঠে। বিকেল নাগাদ পেয়ে যায় দুর্লভ বাসাটি। প্রায় সবাই তার পরিচিত বলেই ব্যাপারটা সহজ হয়েছে। এই মহল্লায় তার বহু বছর যাবত ওঠাবসা।
সন্ধ্যায় একটু দেড়ি করেই বাসায় ফেরে। ছন্দা চিন্তিত। বিকেলের চা – নাস্তা নিয়ে তমালের জন্য অপেক্ষা করে। তমাল যখন ঘরে ফেরে তখন সন্ধ্যা রাতের গায়ে পা দিয়েছে। ছন্দা জানতে চায় এতো দেরি যে? কোথাও গিয়েছিলে? চা তো একেবারে ঠাণ্ডা পান্তা হয়ে গেছে। গরম করে নিয়ে আসি? রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ায় ছন্দা। তমালের বাঁধায় আর যাওয়া হয় না। পেয়ালা হাতেই ধরা থাকে। তমাল বলে আগে শোনো কোথায় গিয়েছিলাম কেনো দেরি হলো।
ছন্দা বলে, বল আগে শুনে নেই। তমাল এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। বলল, বাসা খুঁজতে। আর মজার ব্যাপার হলো পেয়েও গেছি একেবারে তোমার মায়ের বাসার পাশেই। ভাগ্য ভালো বলে তাই। অবাক চোখে ছন্দা তাকিয়ে তমালকে দেখে আর বলে কিন্তু কেনো ? এই তো বেশ আছি। এই বাড়িটা খারাপ কোথায়?
তমাল আমতা আমতা করে বলে তুমি মনে হয় এ বাড়িটিতে ওঠতে প্রথম দিকে বিব্রতবোধ করছিলে। আজিমপুর গোরস্থানের পাশে বলে। ছন্দা তমালের চোখে চোখ রাখতে পারে না। মাথা নিচু করেই বলে এখন আর ভয় পাই না। সব সয়ে গেছে। বেশ ভালোই আছি। ছন্দা আর কিছু বলে না। মিটমিট করে হাসে রহস্যময়ী সে হাসি।