ভাবনাপঞ্জি, কিস্তি—১

১ সেপ্টেম্বর
ছোটবেলায় যখন কুয়াকাটা যেতাম হোটেলে চেকইনের পরপর বেরিয়ে পড়তাম সৈকতের দিকে। এখনও মনে হয় সৈকতের বালি আমি পা দিয়ে খেলার ছলে এলো করে দেব। দেই আসলে এখনও। সেসময় ভিডিওচিত্রে সেই দৃশ্য দেখে চোখ জুড়াতাম—আমি বালি নিয়ে খেলছি! এখন ঐ কাজ করতে গিয়ে আমি বালির উত্তাপটুকু খুঁজতে চাইব। পায়ের বুড়ো আঙুলে বলি খুঁটতে গিয়ে পরিমাপ করব মনে মনে—কতটুকু বালি পায়ের নখে আটকাল! এবং অবশ্যই এক দৌড়ে খাড়ু পানিতে নেমে গিয়ে পা ভেজাব। আসলে মানুষ দেখবে পা ভেজাতে। আমি ত অনুভব করব ঢেউয়ের তোড়ে বালি চলমান—আমাকে নিয়ে কোথাও পালাতে চাইছে দুঃসাহসী পলায়নপরের মতো! আমি ক্রমে গভীরের পথে না হেঁটেও হাঁটছি বালির হাতে পা তুলে দিয়ে! সহসা বুকের ভেতর একটা মোচড় পড়ে—পালানো যাবে না! হারানো ত যাবেই না! হোটেল রুমে ফিরতে হবে! সন্ধ্যা নামার আগেই ফিরতি বাস!
ঢেউয়ের তোড়ে স্থির থাকতে আমি শিখেছি সেই ছোট্টোটি থাকতে। এরপর প্রতিবার—যখনই সমুদ্রে গেছি, পা পুড়িয়েছি, ভিজিয়েছি পা। চর্চা করেছি স্বেচ্ছায়—জলযুদ্ধে টিকে থাকবার বিদ্যা।
সেজন্যই বোধকরি আগুনমুখায় তুফান এলে ট্রলারভর্তি মানুষের আহাজারিতেও আমি, খেই হারাই না! জানি—টিকে থাকবার বিদ্যা আমার জানা।
আমার গল্প বড়ো করবার উদ্যোগে এই অস্তিত্ববাদী বিদ্যাটা দারুণভাবে কাজে আসছে! একবার মনে হচ্ছে এই বুঝি মূল লেখা রেখে পালাচ্ছি দূরে কোথাও। ঠিক তক্ষুণি আমি নিজের লেখকশরীর ধরে প্রচণ্ড এক ঝাঁকুনি দিয়ে ফিরে আসি ঠিক যেখান থেকে পথ হারানোর শুরু!
এ বছর কল্লোল লাহিড়ীর ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’ উপন্যাসে তাঁকে খেই হারিয়ে ফিরতে দেখেছি বারবার।
সবচে বেশি স্পর্শ করছে আমাকে এইটে—আমি গত আট মাসের পড়াশোনার অভিজ্ঞতা লিখতে বসে জাবর কেটে কেটে কিপ্যাডে বুড়ো আঙুল চালাতে পারছি! আমার মতো ছোটো মানুষের জন্য এ একটা বিশাআআআল ‘খাইছে’!
সবচে বেশি স্পর্শ করছে আমাকে এইটে—আমি গত আট মাসের পড়াশোনার অভিজ্ঞতা লিখতে বসে জাবর কেটে কেটে কিপ্যাডে বুড়ো আঙুল চালাতে পারছি! আমার মতো ছোটো মানুষের জন্য এ একটা বিশাআআআল ‘খাইছে’!
- ডিটেইল করতে গিয়ে
ডিটেইলিংয়ের ব্যাপারে আমি দারুণ উৎসাহী পাঠক। গত আটমাসে যাঁরা আমাকে দেখেছেন, জানেন হয়তো টুকটাক। আমি শুধু এই একটা জিনিসে জোর দিয়েই লিখতে বসে হাতে হাতে ফল পাচ্ছি। যে গল্প থেকে উপন্যাসের রেখা বের করে চলেছি, সেই বক্রপথটিকে সরল করেছে আমার সামনে, ডিটেইলিং। এ কাজ করতে গিয়ে এমন কিছু চরিত্র পাচ্ছি, কাহিনির ডালাপালা ছড়ানোর সুযোগ পাচ্ছি, লিড পাচ্ছি, যা নিয়ে ভাবনাই আসত না ডিটেইলিং ব্যাপারটাকে গুরুত্ব না দিলে।
এই কদিনের পাঠ অভিজ্ঞতার কোথাও বলেছিলাম—সুদূর থেকে এক লোক ওঁর লেখা বই উড়ো নামে আমাকে উপহার দিয়েছে। ডিটেইলিং নেই বলে আমার পড়তে ভালো লাগেনি জানাতেই থলের বেড়াল মিউ মিউ করতে লাগল—ডিটেইলিং আমার ভালো লাগে না, আমি ইন্টারনেটে পাইনি কীভাবে উপন্যাস লিখতে হয়। তাই আমার মতো লিখেছি!
আমি হরিশংকর জলদাসদা’র কাছে যারপরনাই কৃতজ্ঞ—এত বিচিত্র বিষয়ের উপন্যাস সৃষ্টি করেছেন, এখনো লিখে চলেছেন। আমাকে ডিটেইলিংয়ের অমৃতস্বাদ প্রাথমিকভাবে এই ভদ্রলোকই দিয়েছেন।
আমার এই দুঃসাহসী পথচলায় প্রত্যক্ষ ইন্ধন জুগিয়েছেন মোহিত কামাল স্যার, বলেছিলেন—উপন্যাস লেখো। গল্প পত্রিকায় দাও।
সাহস করে এগিয়ে চলেছি। দেখি কোথায় গিয়ে থামে প্রজেক্ট ‘অভিসার’।
২ সেপ্টেম্বর
ছোটবেলায় আব্বার কলেজে ডিনারে যাওয়া হতো বছরে একবার। সে রাতে আমার আকর্ষণের বিষয় থাকত স্প্রাইট। কোকের চেয়ে স্প্রাইটটা বেশি পছন্দ করার কারণ বোধকরি ওর বোতলের রঙ। আরও একটা বিষয় আছে সেটা পরে বলি।
যাবতীয় গুরুপাক খাবারে আমার অনীহা না থাকলেও বিশেষ ঝোঁক বোধহয় স্প্রাইটেই ছিল। আমার বোনের আবার রোস্টের ব্যাপারে এন্তার আগ্রহ।
যখনকার কথা বলছি, তার থেকেও আরেকটু ছোটবেলায়, মনে আছে—আব্বার সিগারেটের প্যাকেট একটার ওপর আরেকটা সিঁড়ির মডেলে বসিয়ে সিঁড়ি বাইতাম হাতের আঙুলে। নাইন্টিজে সিগারেট প্যাকের ভেতরের দুটো বর্গাকার কাগজের টুকরো ছিঁড়ে টিপ বানিয়ে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে শিশুরা খেলত। এ খেলার খেলুড়ে আমিও ছিলাম বটে।
নিজের স্মোকিংয়ের সময়গুলোতে এসব খেলা হয়ে ওঠেনি, তবে মনে পড়ত।
লিখতে বসে যে সমুদ্রের খাড়ুপানির কথা তুলেছি গত ভাবনাপঞ্জিতে, সেই কুয়াকাটায়ও স্প্রাইট অনুষঙ্গ থাকত তখন। জিগ্যেস করা হতো—স্প্রাইট না কোক? যে যাকে ভোট দিত, তার জন্য সে বরাদ্দ থাকত। আমি স্প্রাইটই বেশিবার বলেছি জীবনে।
লিখতে বসে যে সমুদ্রের খাড়ুপানির কথা তুলেছি গত ভাবনাপঞ্জিতে, সেই কুয়াকাটায়ও স্প্রাইট অনুষঙ্গ থাকত তখন। জিগ্যেস করা হতো—স্প্রাইট না কোক? যে যাকে ভোট দিত, তার জন্য সে বরাদ্দ থাকত। আমি স্প্রাইটই বেশিবার বলেছি জীবনে।
আমার উপন্যাসের তৃতীয় চরিত্রের নির্মাণ চলছে। একটা ভাবনা মাথাচাড়া দিচ্ছে—স্প্রাইটের পাইপগুলোকে একটার মাথায় আরেকটা জোড়া দেওয়া একটা ঝামেলার কাজ। আমার উপন্যাসের চরিত্রনির্মাণ শেষে বোধকরি এই পাইপ জুড়ে দেয়ার যজ্ঞ মাথার ঘামের বিন্দুর সংখ্যা বাড়িয়ে তুলবে গুণোত্তর ধারায়। এ প্রসঙ্গে সেই সবুজ বোতলে হলুদ পাইপের কম্বিনেশনটা কেন জানি না, দারুণভাবে মনে পড়ছে!
৩ সেপ্টেম্বর
যাকে কেন্দ্র করে ঘুরে এসে বিন্দু বৃত্তে পরিণত হয়, সে নিজেও একটা বিন্দু। ক বিন্দুকে কেন্দ্র করে খ বিন্দু বৃত্ত তৈরি করলে কোনোমতেই খ বিন্দু একা কৃতিত্ব চাইতে পারে না। এ অধিকার তার নেই। ক বিন্দু খ বিন্দুর মধ্যকার সম্ভাবনাকে একটুখানি লাই দিয়ে উস্কে দেয় বলেই খ বিন্দু থেকে বৃত্তের জন্ম।
যখন লিখতে বসেছিলাম ‘অভিসার’, মিরপুর ছয় নম্বর সেকশনের একটা বাড়ির সাততলার চিলেকোঠার পাশের চিলতে ছাদের ওপর রাখা একটা লোহার আরাম কেদারায় বসে লিখছি আর ইনবক্স করছি কাউকে। সে বলছে—দেখার চোখ বড়ো হচ্ছে… লিখে যান। লিখতে লিখতে পালতে পালতে ফেব্রুয়ারির শেষাশেষির ভাবনা আগস্টের শেষাশেষি গল্পে দাঁড়াল। নাম দিলাম ‘অভিসার’। সেখানে আমি কোনো নায়ক-নায়িকা রাখতে চাইনি। চরিত্র চেয়েছি, গ্ল্যামারবিহীন চরিত্র।
চরিত্রই আমার নায়ক-নায়িকা। সে কারণে নির্দিষ্ট চরিত্রের সাথে স্বাভাবিকভাবে মেলে—এমন কিছু আচরণ দেখাতে চেষ্টা করেছি। প্রাথমিকভাবে আটটা স্পষ্ট চরিত্র ছিল কম বা বেশি ভূমিকার। তবে সকলকেই গুরুত্ব দিতে চেয়েছি।
দেখাতে চেয়েছি—অভিসার মানে উদ্দাম চুমু কিংবা স্পর্শ নয়, বরং আরও অনেক কিছু। বয়সভেদে এগিয়ে-পিছিয়ে শেষ বয়সে গিয়ে রোগশয্যায় স্বামীর কিংবা স্ত্রীর মনে একটুখানি আশা—চুলে বিলি কাটবার নির্ভরতার আশ্বাসও অভিসার হতে পারে।
ত, এই কাজ করতে গিয়ে দেখি চরিত্রগুলোকে টেনেহিঁচড়ে বাড়াতে হচ্ছে না, বরং এরা নিজেদের জায়গা থেকে ডিটেইলিং দাবি করছে।
দাবি পূরণের বিলাসিতা ছাড়তে ইচ্ছে হলো না। যে আরাম কেদারায় বসে আমার ‘অভিসার’ গল্পের প্লট অবতারণা—সেটাতেই বসে সর্বশেষ শুনে এসেছিলাম আমাদের রান্নার খালার বেতনের টাকা চুরি যাবার করুণরসাত্মক কাহিনি।
আমি সেই চিলেকোঠা, সেই খালা, সেই মিরপুর ছয়, সাততলার জীবনের একফালি ফিকে রঙ উপন্যাসের শরীরটাতে যত্ন করে মেখে দিতে কার্পণ্য করব কেন?
আমি খ বিন্দু হয়ে কোনো ক বিন্দুকেই ভুলতে পারব না।
আমার প্রথম উপন্যাসের প্রেরণাদায়ী বাস্তব মানুষগুলোকে, যে যেভাবে যতটুকু সহায়তা, সময়—কথা শুনে হোক, পরামর্শ দিয়ে হোক, অভিজ্ঞতা বিনিময় করে, করিয়ে হোক, দিয়েছেন আমাকে সেই ফেব্রুয়ারির চব্বিশ তারিখ থেকে আজ এবং আগামি যে কদিন লাগে লেখা প্রাথমিকভাবে শেষ করতে সে পর্যন্ত, আমি জানিয়ে রাখছি—আমাদের অভিসার ঘটবে। লেখকের কিপ্যাডের পরিচর্যা পাঠকের মন করবে বলে আশ্বাস পাচ্ছি।
বিশেষ করে পুরোনো এবং নতুন পাঠশালা Centre for Basic Studies গ্রুপকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি পাঠক থেকে আমাকে লেখকের রূপান্তরের সাহস যুগিয়েছেন আপনারা সকলে কম কিংবা বেশি।
৪ সেপ্টেম্বর
বিভূতিভূষণের কোনো গল্প ছোটোবেলায় পড়েছি কিনা মনে পড়ে না। তবে হারিয়ে যাওয়া কোনো গল্প সংকলনের পুরোনো কাগজের লোভনীয় ঘ্রাণের পৃষ্ঠার গায়ে লেখা ছিল হয়তো গল্পের নামের নিচে ছোটো হরফে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। পড়েছিলাম হয়তো ভুলে যাবার জন্য।
পাঠে বিরতির এই ঘোরলাগা সময়ে হাতের কাছে ‘আহ্বান’ পেয়ে উপেক্ষা করতে পারিনি। পড়ে নিয়েছি। ধরে নিয়েছি—বিভূতির গল্প এই প্রথম চেখে দেখা। জমির করাতির স্ত্রীর মধ্যে যে বাৎসল্য, তা গোপাল অবহেলা করলেও, আমি করতে পারিনি।
পাঠে বিরতির এই ঘোরলাগা সময়ে হাতের কাছে ‘আহ্বান’ পেয়ে উপেক্ষা করতে পারিনি। পড়ে নিয়েছি। ধরে নিয়েছি—বিভূতির গল্প এই প্রথম চেখে দেখা। জমির করাতির স্ত্রীর মধ্যে যে বাৎসল্য, তা গোপাল অবহেলা করলেও, আমি করতে পারিনি।
অ মোর গোপাল! কাকে বলি আমি?
ইন্দির ঠাকরুণকে পড়া জরুরি হয়ে পড়ছে দিনদিন। কবে যে পড়ব! কবে যে ছুটি ভাঙবে!
৫ সেপ্টেম্বর
পড়তে পড়তে ভাবনায় পড়ে যাওয়া—এরকম শর্তে কিছু লিখতে গিয়ে উদাহরণ দিতে গেলে এই বিদঘুটে সময়ে পড়া গল্প ‘মধুমতী’র কথা বলা আমার কর্তব্য।
পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভাই, জানলাম। আরো জানলাম এই বংশলতিকায় সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও তাঁদের ভাই। সেদিক দিয়ে ভাষাশৈলীতে বঙ্কিমীয় প্রভাব পূর্ণচন্দ্রের গল্পে পেলেও সঞ্জীবচন্দ্রের ‘পালামৌ’ কিন্তু আলাদা কিছু বলছে ভাষাশৈলীর বিচারে। হয়তো ভ্রমণকাহিনি বলেই। সঞ্জীবচন্দ্রের ভাষায় আমি বরং টেকচাঁদ ঠাকুরের প্রভাব পেয়েছিলাম।
পূর্ণচন্দ্রের গালভরা শব্দচয়নে সমাসবদ্ধতা দেখে আমি একমাত্র বঙ্কিমকেই স্মরণ করেছি। মজার কথা, তখন জানতাম না তাঁরা ভাই!
বলা উচিত কথাটা—’মধুমতী’ আধুনিক বাঙলাসাহিত্যের প্রথম গল্প।
কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার ভাইয়ের বাঙাল পত্রিকার প্ৰথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা বেশ সমৃদ্ধই দেখেছি। এ মহতী উদ্যোগের সফলতা কাম্য।
৬ সেপ্টেম্বর
আটমাস টানা পড়া শেষে এই যে ছুটিতে আছি আমি, তার সবচে ফলপ্রসূ ব্যবহার নিশ্চিত করতে আমি বদ্ধপরিকর। যখন পড়া নেই তখনও তাই পড়া তৈরি হয়ে বসে থাকছে। আমি পড়ছি। বানিয়ে হলেও পড়ছি।
সবচে কাজের কথা হচ্ছে—এই আটমাস এবং পেছনের দিনগুলোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নিজের লেখার হাতটাকে ঝালিয়ে নিচ্ছি।
সেদিন আম্মার সাথে কম্পোজের কাজে গেলাম এক দোকানে। সেখানে হাজির এক ভবঘুরে। কার্তিক পাগলার নাম শুনেছিলাম—একটা লাঠি হাতে এই ছোটো শহরের কল্পিত ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করত। দোকানে আসা ভবঘুরেটাকে কার্তিক পাগলা ধরে নিয়ে ওর গল্প শুনলাম একটুকরো। ওর কাছে না অবশ্য। ওরা নিজেরা এ গল্প বলে না। হাওয়ার কাছে এসব গল্প শোনা যায় নিয়তই।
তারপর শেষে কাল গেলাম আমাদের শহরের ধারঘেঁষে চলে যাওয়া স্বনির্ভর রোডের পাশের লাউকাঠি খেয়াঘাটে। ওর অতীত ভাবতে। মজার বিষয় হচ্ছে—চা খেতে খেতে শুনি ফোনে কোনো এক কার্তিকের ব্যাপারে খোঁজ করছেন গলায় রুদ্রাক্ষধারী এক প্রৌঢ়। তিনি লাউকাঠির ওপারের কোনো একটা বাড়ির ঠিকানাও খোঁজ করছেন। অল্প দূরে মাছ কুটছেন এক বৃদ্ধা আপন মনে। পাশেই এক ছাপড়ায় ঘুম ভেঙেছে সবে আরেক বৃদ্ধার!
আমার এসএসসি থেকে শুরু করে এইচএসসি হয়ে আরো দূর পর্যন্ত বহুদিনের জীবনে লোহালিয়া খেয়াঘাট একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলেও সেটা বোধকরি এমন গল্পপ্রসবী স্থান হয়ে ওঠেনি।
আমার এসএসসি থেকে শুরু করে এইচএসসি হয়ে আরো দূর পর্যন্ত বহুদিনের জীবনে লোহালিয়া খেয়াঘাট একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলেও সেটা বোধকরি এমন গল্পপ্রসবী স্থান হয়ে ওঠেনি।
লাউকাঠি খেয়াঘাটের গর্ভে গল্পের খনি টের পেয়েছি আমি কাল। এখানে ছিন্নমূল-যুক্তমূল, মাছবুড়ি, সুস্থ-অসুস্থ হাজারো গল্পের কাঁকড়া ভ্রূণ নিষিক্ত করে ছুটে চলে যায় আবার আসে। এই জায়গাটাকে আরও ভালোভাবে দেখবার এবং লিখবার লোভ আমি কী করে সামলাই?
যদি লাউকাঠি গল্পের খনি হয়, তাহলে লোহালিয়া, পুরান বাজারও কম যাবে না সে দৌড়ে। আমিও দৌড়ুবো। এ গল্পের গলির শেষ মাথায় পৌঁছে আমি আলোর সাথে সাক্ষাৎ করবই।
৭ সেপ্টেম্বর
‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’ এদেশে সাশ্রয়ী দামে এনে দিচ্ছে বুকস অব বেঙ্গল। তাদের মহতী উদ্যোগ প্রশংসনীয়। এ বইটি তাদের থেকেও কম দামে পাওয়া যায় নীলক্ষেতকেন্দ্রিক কিছু অসাধু ব্যাবসায়ীর কাছে। সেখান থেকে এরকম পাইরেটেড কপি ছড়িয়ে গেছে অনলাইনে। ফলে এখন সাড়ে তিনশ টাকার বই একশ তিরিশ টাকায় নিম্নমানের ছাপায় পড়ে চোখের বারোটা বাজাচ্ছি আমরা। শ্রীপান্থর ‘ঠগী’সহ পশ্চিমবঙ্গের আরো কিছু ট্রেন্ডিং বইয়েরও ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। অথচ লেখক প্রকাশকের সাথে কথা বলা বোধহয় বর্তমানে এমন পাইরেসি রোধকল্পে সহায়ক। তাতে আমরাও কমদামে মানসম্পন্ন ছাপায় বই পেতে পারি।
‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’-এর অবস্থা দেখে বুঝতে পারলাম নীলক্ষেত আমাদেরকে একদিক দিয়ে দুহাত ভরে দিয়ে, অন্যদিক দিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎশূন্য করছে।
কিন্তু নীলক্ষেতের বাইরের অন্যদের কী হাল?
পলাশ প্রকাশনী।
পল্লীকবির সকল বইয়ের এদেশে একমাত্র প্রকাশনা সংস্থা।
আজ ‘স্মরণের সরণী বাহি’ বইটার প্রচ্ছদের কাগজের মান দেখে যারপরনাই হতাশ হয়েছি। এ কার্টে আমি তাঁর সাতটা বই পেয়েছি। তাদের হোয়াইটপ্রিন্ট/নিউজপ্রিন্টের যে গোঁজামিল, তা বড়ো বেশি অপেশাদারী মনোভাবের পরিচায়ক। পল্লীকবির বই হিসেবে প্রথম আমি বোধহয় ‘সুচয়নী’ কিনেছিলাম। যতদূর জেনেছি পলাশ প্রকাশনী তাঁর পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের প্রকাশনায় পারিবারিক পর্যায় থেকেই অবহেলা আছে কি না—পরিস্কার নয় ব্যাপারটা। ভারতে, পশ্চিমবঙ্গের কথা বলছি—দে’জ অথবা আনন্দ পাবলিশার্স উনার ব্যাপারে যতটুকুই কাজ করেছেন, কেন করেছেন? তাঁরা ত তাঁর পারিবারিক কেউ নন।
জীবনানন্দ দাশ আমাদের বরিশালের সন্তান। আমরা তাঁকে নিয়ে ভাবি না বটে, পশ্চিমবঙ্গের এক সজ্জন গবেষক গৌতম মিত্রকে নিয়মিত দেখে যাচ্ছি জীবনানন্দ নিয়ে লিখে যাচ্ছেন এখানে সেখানে।
জীবনানন্দ দাশ আমাদের বরিশালের সন্তান। আমরা তাঁকে নিয়ে ভাবি না বটে, পশ্চিমবঙ্গের এক সজ্জন গবেষক গৌতম মিত্রকে নিয়মিত দেখে যাচ্ছি জীবনানন্দ নিয়ে লিখে যাচ্ছেন এখানে সেখানে।
আমরা কী করছি?
আবুল মনসুর আহমদ। তাঁরও পারিবারিক প্রতিষ্ঠান আহমদ পাবলিশিং হাউস। এঁরাও নানা কারণে ভালো কাগজে বই দিতে না পেরে প্রথমার মতো প্রতিষ্ঠানকে বাধা দিচ্ছে না প্রকাশিত গ্রন্থের প্রকাশে। হতেই পারে। সমস্যা কোথায়?
পলাশ প্রকাশনী কি পারে না অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে এরকম লিখিত অনুমতি দিতে?
‘বউ টুবানীর ফুল’, ‘বোবা কাহিনী’র মতো মাস্টারপিস পড়তে পড়তে পাঠানুভূতিতে কাঁদব কী? ছাপাজনিত সংকটে পড়ে বিরক্ত হয়ে যাই।
আমার জানামতে নাঈম বুকস নামের প্রতিষ্ঠানটির ছাপার মান সবচে বেশি পাঠক-অবৎসল। এ তালিকায় এরপরই যদি পলাশ প্রকাশনীর নাম মনে আসে—সেটা ঠিক কতটা ভালো কথা?
৮ সেপ্টেম্বর
জুন মাসের পাঠপঞ্জি প্রজেক্টে আমি সবচে’ কমসংখ্যক বই পড়লেও গুণগত দিক বিচারে ভালো পড়াশোনা করেছি। এ মাসেই জসীম উদ্দীনের ‘বোবা কাহিনী’ পড়েছিলাম। চিরায়ত এ উপন্যাসটি এতদাঞ্চলের গ্রামীণ পরিবেশকে অনেকটা নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরেছে। সে অনুপাতে লেখাটা তেমন প্রচার পায়নি বলেই প্রতীয়মান।
আঞ্চলিক ভাষার সংলাপবহুল উপন্যাসের তালিকায় ‘বোবা কাহিনী’ অনায়াসবিবেচ্য। বিশেষ করে পদ্মাতীরবর্তী ফরিদপুরের গ্রামীণ আঞ্চলিক ভাষাকে এতটা নিখুঁতভাবে তুলে এনেছেন পল্লীকবি, ভাবতেই শিহরণ জাগে। অপরাপর আঞ্চলিক ভাষারীতির নির্মাণের উপন্যাসে ভাষার ঐক্য নিয়ে অভিযোগ করলেও, ‘বোবা কাহিনী’তে এ সুযোগ নেই বললেই চলে।
এ উপন্যাস পড়তে গিয়ে রহিমদ্দি চরিত্রটি আমাকে খুব করে টেনেছে এজন্য যে, বাঙলা ভাষায় নিম্নবর্গের জীবনাশ্রিত উপন্যাসের তালিকায় আমি জোলা বা মুসলিম তাঁতি সম্প্রদায় পেয়ে উঠিনি বহু খুঁজেও। রহিমদ্দির অল্পস্বল্প বিবরণে লোভটা বাড়ে। ফলশ্রুতিতে খোঁজখবর করবার মাত্রা বাড়তে থাকে। পেয়ে যাই সমরেশ বসুর ‘টানাপোড়েন’ আর পাপড়ি রহমানের ‘বয়ন’।
সমকালীন পড়তে গেলে ইদানীং ভয় লাগে—কোথাও না কোথাও লেখায়, বিরক্তিকর, রাগ উৎপাদক এবং আশঙ্কাজনক ছেলেমানুষী ধরণের ত্রুটি পেয়ে যায় শকুনের চোখ। সে কারণে সুনির্বাচিত কিছু লেখক ছাড়া আর কারুর লেখা পড়তে একটা অযাচিত অনীহা এসে যায়।
সমকালীন পড়তে গেলে ইদানীং ভয় লাগে—কোথাও না কোথাও লেখায়, বিরক্তিকর, রাগ উৎপাদক এবং আশঙ্কাজনক ছেলেমানুষী ধরণের ত্রুটি পেয়ে যায় শকুনের চোখ। সে কারণে সুনির্বাচিত কিছু লেখক ছাড়া আর কারুর লেখা পড়তে একটা অযাচিত অনীহা এসে যায়।
ব্যাপারটা এমন হয়—যে লেখকের উচিত হতো পাঠকের সামনে লজ্জিত থাকার, তাঁর সামনে পাঠকেরই লজ্জায় পড়তে হয়, পরবর্তী বই কিনবে না, এই অস্বস্তির কোপে পড়ে।
একটা তেতো সত্যি হচ্ছে ফেসবুক আমাদেরকে ফেসবুকীয় লেখক বানিয়েই দায় সেরেছে। ‘ক্ল্যাসিক ইজ’ ভুলিয়ে দিয়েছে কথ্য এবং লেখ্য—উভয় ভাষাশৈলীতে।
কাটতি খুঁজে খুঁজে এখন লেখক তার উপন্যাসের ভাষাশৈলী নির্ধারণ করেন, সমাজতত্ত্ব হাতে ধরে বানান। এগুলো আদতে হাস্যকর প্রচেষ্টা। দিনশেষে তবু এগুলোরই জয়জয়কার।
‘বোবা কাহিনী’র নাম হয় অশ্রুতপূর্ব।
বেস্টসেলারের তকমা জোটে না ‘বয়ন’, ‘জলপুত্র’ এর মতো জীবনাশ্রিত কাহিনির কপালে।
৯ সেপ্টেম্বর
ছেঁড়া তালপাতা বিরুদ্ধস্রোতে হাঁটা এক পাঠকের প্রতিষ্ঠান।
তার জন্ম ২০২০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি।
সে বর্তমানে দোকলা।
আমি রেজওয়ান আহমেদ এবং আমাদের বন্ধু সিদ্দিক রানা—আমাদের দুজনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় পথ চলছে সে।
এ আপাত-অলাভজনক, শিক্ষামূলক পেইজে আপনাদের সকলের ভালোবাসা এবং অংশগ্রহণ আমাদের প্রয়োজন।
আপনারা যাঁরা বইপত্রে আগ্রহী, তাঁদেরকে পেইজে সংযুক্ত হবার আহ্বান জানাই।
এ পোস্টে সংযুক্ত একটা ছবিতে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন আমার এক বন্ধুর প্রতিক্রিয়া। এগুলো কাজ করতে উৎসাহ যোগায় খুব।
পটুয়াখালী শহরের বইপাড়া বলতে সদর রোডে ছয় কি সাতটা বইয়ের দোকান এখন টিকে আছে। কোনোমতে।
বেশিরভাগই সিলেবাস এবং চাকরিসর্বস্ব। করোনার ছোবলে এসব দোকানের এখনও হাহাকারদশা কাটেনি।
বইঘর বোধহয় নাই হয়ে গেছে। বইঘরের আঙ্কেল বহুদিন হয় এমদাদিয়ায় বসে ঝিমান আর সিগারেট খান। আমি গেলে ক্ষয়ে-যাওয়া-দাঁত বের করে হেসে দেন। আন্তরিক সে হাসি। আড়ালে হতাশা। বিক্রিবাট্টা নেই।
মনে পড়ে, ক্লাস এইটের শেষ অথবা নাইনের শুরুতে তাঁর কাছে গিয়ে বলেছিলাম—ভালো মানের উপন্যাস দিন। উনি আমাকে ‘গৃহদাহ’ আর ‘দত্তা’ দিয়েছিলেন। তাই ঐ বয়সে আর সবার মতো ‘পল্লীসমাজ’ নয়, বরং ‘গৃহদাহ’ আর ‘দত্তা’য় ‘ঠোঁটেবই’ হয়। উনি আমাকে খুঁতখুঁতে পাঠক হবার রাস্তায় উঠিয়েছেন।
উনি জানতেন এবং এখনো জানেন আমাকে ‘ফুটন্ত গোলাপ’ অথবা ‘বোরকা পরা সেই মেয়েটি’ দেখিয়ে লাভ নাই, লাভ নাই তথাকথিত বেস্টসেলারের তালিকা আউড়ে। তাই পরেরবার যখন যাই আমাকে দেখান ‘পথের পাঁচালী’, ‘জননী’ (শওকত ওসমান)। সেটা এখন থেকে বছর দুয়েক আগের কথা। করোনার পর সর্বশেষ দুবার গিয়ে ছবির বই দুটো এনেছি। এর মধ্যে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ দু’বছর আগেও দেখেছিলাম, আনিনি। এবার যখন নামালেন ডিসপ্লে থেকে, স্যানিটাইজ করে আমার হাতে দিলেন।
জানতে চাইলাম আরও কিছু বই পাব কি পাব না। জানতে চাইলাম—দুই বছরে আমার পড়ার টেস্ট বদলে গেছে, আর এই বই দুই বছরেও কেউ নেয় নাই? গম্ভীরভাবে বললেন—বই ত আনি না আর আইজকাইল!
জানতে চাইলাম আরও কিছু বই পাব কি পাব না। জানতে চাইলাম—দুই বছরে আমার পড়ার টেস্ট বদলে গেছে, আর এই বই দুই বছরেও কেউ নেয় নাই? গম্ভীরভাবে বললেন—বই ত আনি না আর আইজকাইল!
ঘটনা কী? ঘটনা ফেসবুক। সবাই আইজকাইল ফেসবুক চালায়। বই পড়ে কেডা?
বড়ো গলায় ছোটো করে বললাম—আমি কাজ করি বই পাঠ নিয়ে পটুয়াখালীতে।
ছোট গলায় দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে উনি বললেন—তুমি একলাই। চালাইয়া যাও বাজান।
আমি স্যানিটাইজ করা ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ একটা হালকা-সবুজ-রঙা কাপড়ের ব্যাগে ঢুকিয়ে মাথা নামিয়ে রাতের আলো-আঁধারিতে মুখ লুকিয়ে ফিরতি পথে পা বাড়ালাম।
১০ সেপ্টেম্বর
মাল্টিটাস্কিং করে কোনোদিনও আমার ভালো কিছু হয়নি। তবু আজ তাই করলাম। দুটো গল্পের রিভিউ, একটা চলতি পাঠ, পেইজের লাইভ, মৌলিক লেখার আগাম ভাবনা করে দিন শেষ করে ক্ষান্ত হইনি।
গল্প দুটো যে সিলেবাসের? সে হিসেব ধরলে আমি পরীক্ষার পড়াও পড়েছি বটে।
এতকাল ক্লাস-পরীক্ষা না থাকায় জীবন একমুখী চলেছে। এখন বহুমুখী চলতে হবে। কোনো বিকল্প নেই। আমি ত না পড়ে থাকতে পারব না।
[চলবে]