শত বছরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : জ্ঞান ও স্বপ্নের ফেরিওয়ালা

১৯১১ সালে করা বঙ্গভঙ্গরদের ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে দিতে ১৯২১ সালের ১ জুলাই ব্রিটিশ সরকার প্রতিষ্ঠিত করে দেশের প্রথম উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যা ছিল এপার বাংলার মানুষের প্রাণের দাবি। নানা চড়াই উতরাই পেরিয়ে সংগ্রাম ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞানের প্রদীপ শিখা বিলিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় জ্ঞানের বাতিঘর হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজ এই ২০২১ এর হাত ধরে অতিক্রম করেছে তার জন্মের ১০০তম বছর। শুভ হোক পথচলা।
বাংলাদেশের সৃষ্টিতে এবং দেশকে এগিয়ে নিতে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের এত বড় ভূমিকা সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র হতে পেরে আমি অনেক অনেক গর্বিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ১০০ বছরের মধ্যে যে আমারও ভাগ রয়েছে ৫টি বছরের, রয়েছে অনেক স্মৃতি জমা। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শুনলেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি।
হাজারও স্বপ্নের জাল বুনে এখানে সন্ধ্যা আসে তারুণ্যের কলকাকলিতে। জ্বলে ওঠে সোডিয়ামের বাতি। স্বপ্ন ও জ্ঞান যেন খেলা করে সে বাতির আলোয়। কলা ভবন কিংবা ফুলাররোড কিংবা কার্জন সব খানে ছড়িয়ে থাকে তারুণ্য, বন্ধুত্ব, আড্ডা। এ যেন নিত্যদিনের চিরচেনা সাজ আমার প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলো আমার নব যৌবনের প্রথম প্রেম, যার টানে শিকড় ছেড়ে শহরে ছুটে আসা। প্রত্যাশা মানুষ হব,শ্রেষ্ঠ মানুষ, মানবিক মানুষ। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি যে মানুষ গড়ারই কারিগর। এই নিঃসঙ্গ তরুণকে তখন প্রেয়সীর মতোই উষ্ণ আলিঙ্গনে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিল ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়। তারপর পাঁচবছর ধরে পথ হেঁটেছি তারই হাত ধরে। দুজনে জন্ম দিয়েছি কত স্মৃতি, কত কবিতা, কত গান, কত বন্ধুত্ব, কত মান-অভিমান। নকশি কাঁথার সেলাইয়ের মতো করেই বুনেছি প্রতিটি মুহূর্ত। ক্লাস রুম কিংবা করিডরে, সেখান থেকে অপরাজেয় হয়ে বটতলায় বন্ধুদের সাথে আড্ডা-খুঁনসুটি, কখনো বা শ্যাডোর লেবুর জুসে চুমুক দিতে দিতে ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ায় ঢুকে ২০ টাকার খিচুড়ি ভোজ যেন সবারই নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। তারপর বন্ধুরা মিলে লাইব্রবীতে ঢুকে বইয়ের পাতায় দিতাম মনোযোগী চোখ।
সবচেয়ে বেশি আড্ডা জমে উঠত টিএসসিতে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে। টিএসসি যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ। হাজারও শিক্ষার্থীর আড্ডা-গানে কিংবা বন্ধুদের গ্রুপ স্টাডিতে সদা মুখরিত থাকে এই প্রিয়প্রাঙ্গনের প্রিয় জায়গাটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে আর টিএসসির প্রেমে পড়েনি এমন ছাত্রছাত্রী পাওয়া বিরল। টিএসসি কারো জন্য আড্ডার জায়গা, কারো জন্য পড়ার, কারো জন্য নিজেকে মেলে ধরার, কারো জন্য তার প্রিয়ার সাথে কিছু সময় ভাগাভাগি করার।
কবির কবিতা বলে –
“ভালোবাসার ক্যানভাস রাঙায় টিএসসির ওই ঘাস
মিষ্টি আবেশ ছুঁয়ে যেত প্রিয়ার চোখের আকাশ।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক ছিল আমার দ্বিতীয় আবাস।এ হল ছিল আমার কাছে স্বর্গের মতই। আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পাঁচটি বছর এ হলেই কাটিয়েছি।এ যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অকৃত্রিম আধার।এখানে জলেস্থলে খেলা করার সমান সুযোগ রয়েছে। ইচ্ছে হলেই বিশাল পুকুরে লাফিয়ে পড়ে সাঁতার কেটে মেতে ওঠা যায় কৈশোরের দস্যিপনায়। হলের টিভি রুমে বিশ্বকাপ ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলা দেখার কী যে আনন্দ!! বন্ধুদের সাথে ফুলার রোড ধরে শহীদ মিনার হয়ে কার্জনের পথে হাটা হাটি যেন এক অনিন্দ্য সুন্দর স্মৃতি।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের নানা স্মৃতিই মনের কোণে জেগে ওঠে সেই চেনা সুরে। যেমন নতুন বছরকে বরণ, পহেলা ফাল্গুনের রঙিন উৎসব, বকুলতলার গান, সবই যেন উৎসবের আমেজ ঢালা দিন। আর এভাবেই যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে ধারণ ও বহন করে নিয়ে যাচ্ছে নতুন ভবিষ্যতের অভিমুখে। এদিক থেকে বলা যায় ,দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করে চলেছে দেশের এই সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ।

বাংলাদেশের জন্মও এগিয়ে চলায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, রয়েছে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে গৌরজ্জ্বল ভূমিকা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৬২, ১৯৬৯ এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন দেশের পতাকা অংকনে রেখেছে অগ্রণী ভূমিকা। নব্বইয়ে ফুসে উঠে ঘটিয়েছিল স্বৈরাচারের পতন। নিজ হাতে সৃষ্টি করে যাচ্ছে বিশ্ববরেণ্য অগণিত ব্যক্তিত্ত্বের যারা গৌরবান্বিত করছে স্বদেশকে, বিশ্বদরবারে মেলে ধরছে নিজেদের আসন। শত বাধা পেরিয়ে ১৯২১ সালের ১ জুলাই মাত্র ৮৪৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে জন্ম নেয়া সেই স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন কোটি শিক্ষার্থীর পরিবার। তাই প্রার্থনা করি- জ্ঞানের আলোক শিখা লক্ষ্য প্রাণে ছড়িয়ে দিয়ে দেশের মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনুক। শিক্ষা, গবেষণা ও জ্ঞানে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে স্বপ্ন ফেরি করে যাক হাজার বছর ধরে। আমি জানি তুমি বৃদ্ধ হবে না, তুমি চির যৌবনা।
মো. আব্দুল মান্নান, ইংরেজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়