জোছনা সিনান, পর্ব : ৪

দেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শত বছর পূর্তি উপলক্ষে থাকবে বইচারিতার বিশেষ আয়োজন। ধারাবাহিকভাবে লিখছেন কবি, লেখক ও সংগঠক শামীম আজাদ । আজ থাকছে ৪র্থ পর্ব।
তখন না ছিল মোবাইল, না করা যেত রোকেয়া হলের অফিস থেকে ফোন। সারা হলের মেয়েদের জন্য মেইন বিল্ডিংয়ে খোলা অঞ্চলে খাবি খাওয়ার মত একটি কংক্রিটের পিলারের মধ্যে ঝুলে থাকত একটি মাত্র ফোন। আর তার যা চাহিদা! তাতে কি করে পয়সা দিতাম বা কত দিতাম আজ আর মনে নেই কিন্তু ঘি রঙা চ্যাপ্টামত ফোনটাই ছিল আমাদের পাবলিক ফোন।আমাদের প্রাণ ভ্রমরা। এখন কথা হল, এই ফোনের ভোক্তাদের নিয়ে। প্রেমে পড়াদের সহজেই সনাক্ত করতে পারতাম। কারণ খাবার ঘণ্টা পড়লে ওরা ছাড়া সকল প্রজাতিই বড় রুই মাছের টুকরোটা পাবার জন্য ডাইনিং হলে দৌড়াতে লাগাত। এতে ওরা পেয়ে যেত ফকফকা জনহীন ফ্লোরের পাইভেসি। অথবা খাবারের পর আমরা সবাই যখন ঢাকার ডিআইটি ভবন থেকে ( পরে বিটিভি) শহীদুল্লাহ কায়সারের লেখা ও সংশপ্তক (বোধ করি প্রথম ধারাবাহিক ) দেখতে কমনরুমে গিয়ে লেয়ারে লেয়ারে দাঁড়িয়ে বসে ঠাসাঠাসি কাঁঠালের কোয়া হয়ে যেতাম তখনো। এদিকে নাটক শেষে হুরমতির ভূমিকায় রোজী সামাদ, লেকুর চরিত্রে এ টি এম শামসুজ্জামান আর রমজানের চরিত্রে কেরামত মাওলা ছিলেন। কয়েক পর্ব দেখানোর পর তা বন্ধ হয়ে যায়। যুদ্ধের পর আবার শুরু হলে এতে হূমায়ুন ফরিদী নামের এক নতুন যুবার অভিনয় আমাদের কি ভাবে একদম মাথা খারাপ করে দিয়েছে তা বলতে বলতে রুমে ফিরতাম- দেখতাম তাদের। সত্তর দশকের শেষে কিংবদন্তি সম্পাদক শাহাদত চৌধুরীর সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কাজের সময় ফরিদীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হলে প্রায়ই তার সেই বিখ্যাত ‘কানকাটা রমজান’ উপাধি নিয়ে হাসাহাসি করতাম।

তো বলছিলাম রোকেয়া হলের ফোনের কথা। একদিন আমি অনার্স বিল্ডিংয়ে ডলির কাছ থেকে ফিরছিলাম। ডলি, আমার কিশোরী বেলার বন্ধু। তখন আমরা আব্বার চাকরি সুবাদে মিষ্টি মহকুমা শহর জামালপুরে ছিলাম। ডলি ঐ তেরো বছর বয়সেই ছিটের কাপড় ধাই ধাই করে কেটে সিঙ্গার সেলাইর মেশিনে টেডি পাজামা ও টাইট কামিজ বানাত। আমি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকতাম। ফজরের নামাজের পর আমরা দু’জন খালি রাস্তায় ওর মজনু ভাইয়ের সাইকেলের মধ্যখানে পা ঢুকিয়ে শরীর বাঁকিয়ে তা চালানো শিখতাম। ও ছিল ফ্যাশনের দিক থেকে এগিয়ে।
সে সময় আমরা ইংরেজি সিনেমা দেখতে গুলিস্তানে নাজ সিনেমায় যেতাম। নিউমার্কেট ও ঢাকা কলেজের উল্টাদিকে ‘বলাকা’ সিনেমা দালানে এক চীনা রেস্তোঁরা ছিল।৬০ দশকের পশ্চিমের সাদাকালো ছবিতে অড্রে হেপবার্ন, সোফিয়া লোরেনের সানগ্লাস পরা আমাদের যেমন উৎসাহিত করেছে তেমনি করেছে আমাদের দেশের সত্তরের নায়িকাদেরও। চিত্র নায়িকা শবনম, সুলতানা জামান ও রোজী এদের সানগ্লাস আমাদের উপর বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল। আমরা সানগ্লাসকে গগলস বলতাম আর ওটা পরলেই স্টাইল হলো ভাবতাম। ছবি দেখে দেড় দু’টাকায় শুধু স্টার্টার বা স্যূপ খেয়েই আমরা চরম আনন্দ করেছি। আমার টা ফোয়ারা বা কনির মত অত মডার্ণ নয়। ডলিই দেখিয়ে দিলো নাকের ঠিক কতদূর নামিয়ে পরলে আমাকে স্মার্ট লাগবে। ফেরার সময় দেখি ফোনের রিসিভারে স্প্রিংয়ের মত যে তার আছে তাতে টান মেরে উৎস থেকে দূরে গিয়ে তৃতীয় বর্ষের এক আপা নিজের মুখটা আড়াল করার চেষ্টা করছেন। তার কন্ঠ ভারি। হাতে সান গ্লাস! বুঝলাম স্টাইল ছাড়াও সানগ্লাস কান্না ঢাকতেও বোধকরি কাজে লেগেছে।

তবে আমাদের কান্নার জন্য ঐ খোয়াওঠা পুকুর পাড়ই ছিলো জনপ্রিয়। যখন যায় বন্ধুকে একান্তে কথা বলে কাঁদবার দরকার হত সোজা পুকুর পাড়ে চলে যেত। রাশেদা তো প্রায়ই পুকুরের জলেভাসা পদ্মপাতা ও ব্যথিত বন্ধুর মুখের দিকে চেয়ে হেমন্তের গাওয়া গান অথবা রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইত। একটি ছোট নৌকোও ছিলো। তবে নিষেধ ছিলো চড়ার। হয়তো মালি নামিদা ওটা দিয়ে পুকুরের জলজ আগাছা পরিষ্কার করতেন। হয়তো নৌকোটা ঠিক চড়বার উপযুক্ত ছিল না। কিন্তু লাইজুকে আটকায় কার সাধ্য! তার বাহাদূরীতে রাবেয়াও প্রগাঢ় বিশ্বাসে তাতে গিয়ে উঠতেই যা হবার তাই হলো। ঘাট ছাড়াতে না ছাড়াতেই নৌকা গেল উলটে। রাবেয়া সাঁতার জানতো না। ও যখন খাবি খাচ্ছে তখন লাইজুর নজরে পড়ে। কিন্তু তখন তাকে তুল্লেও এই অভিমানে রাবেয়া তিন মাস তার প্রাণের বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে না। এই দুর্দান্ত লাইজুই টিএসসিতে সেলিম আল দীনের ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুনে’র প্রথম সেই নারী যে সারা গায়ের অসংখ্য বেলুন আটকে গুরতে ঘুরতে মঞ্চে প্রবেশ করে। বিয়ের পর লন্ডনে এসেও নানান চ্যালেঞ্জিং পেশার শেষে এখানের স্কুলে্র এওয়ার্ড উইনিং শেফ হয়ে বাংলাদেশের নাম করে। আর রাবেয়া ঢোকে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিসে।
আমাদের হলের পেছনেই জগন্নাথ হল। তার প্রভোস্ট ছিলেন আত্মভোলা অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব। আমরা তাঁকে জি সি দেব স্যার বলেই জানতাম। একাত্তরের শহীদ এই সহজ সরল মানুষটি শ্রাবনীকে খুব স্নেহ করতেন। স্যার সব সময় রোকেয়া হলের সামনে দিয়ে অগোছালো কাঁচাপাকা চুলে একদল ছাত্রছাত্রী পরিবেষ্ঠিত অবস্থায় তাঁর আসবাব পত্রের বাহুল্যহীন কোয়াটারে ফিরে যেতেন। শুনতাম, অকৃতদার স্যারের বাসায় মুড়ি মাখাই নাকি ছিল অন্যতম জল খাবার। তা তিনি রাস্তার মানুষকেও ডেকে এনে খাওয়াতেন। মাঝে মাঝে শ্রাবনীর জন্য মিষ্টি নিয়ে আসতেন। কিন্তু আমার বন্ধুরতো টাইমের কোন বালাই নেই। তখন রোকেয়া হলের বাইরে দাঁড়ানো যে কেউ এমনকি রিক্সাওলাদের খাইয়ে তিনি ফিরে যেতেন।
এখন টিএসসির কোনায় শামীম সিকদারের ভাস্কর্য ছিল না। শারদীয়াতে আমরা টিএসসির বুদ্ধ নারকেল গাছের নিচে ঘোরাঘুরি করতাম। একটাই কারণ, সেটা হল জগ্ননাথ হলের দিকে তাকিয়ে থাকা। সেখানেই লেগেছে পূজার ধূম। তাতে আমরা রসুন বেটেছি, এখন যুবকদের দেখার উপায় কি! উপায় রুমমেট শ্রাবণী এন্দ। পূজা দেখতে হলে এ পাটকাঠিই ভরসা। ওকেই সামনে শিল্ড বানিয়ে ডাক সাঁইটে প্রভোস্ট আপার কাছ থেকে আমাদের অনুমতি পাওয়া গেল। তাতে মহানন্দে শ্রাবণী তার মার্কা বিশাল টিপ পরল। আমি পরলাম খালামনির চায়না সিল্ক। একরঙা পাড়, জমিনে সে রঙের ওপর ঘন প্রিন্ট। দাম পঁয়তাল্লিশ টাকা! মাত্র নতুন এসেছে। হলে প্রবেশ করে একবার পূজা দেখি একবার সুন্দর সহপাঠী বা ছেলেদের দেখি, আর আড্ডা দিই। দুদিন গেল মহানন্দে, আমাদের পাসপোর্ট ফুরাল। এখন শুধু শ্রাবণী আর বানী যেতে পারবে। সে যায় আর আমরা সবাই রোকেয়া হলের পানসে ডাল খেয়ে ওর ফেরার অপেক্ষায় পুকুর পাড়ে বসে থাকি। একদিন সে আর বানী ফিরে এল, ভিড়ের চাপে বানীর শাড়ি ছেঁড়া আর খালি পায়ে শ্রাবণী। তার হাতে পাটি স্যান্ডেল! যেন গোপাল এসে তার আরেক পাটি পৌঁছে দেবে আরকি!
সে সময় আমরা সুতিই পরতাম। নিউমার্কেটের রূপায়ন নামে একটি দোকানে থান কিনে ব্লকপ্রিন্ট করিয়ে নিতাম। অথবা গেটের কাছে ঝুড়ি থেকে স্যান্ডেলের মত মাঝে মাঝে শাড়িও কিনতাম। পয়তাল্লিশ টাকার শাড়ি মহা মূল্যবান। আমি প্রথম পরার পর ঐ এক শাড়িই পরের তিন সপ্তাহ ভাগাভাগি করে পরে যে যার মত তাতে সেফটিপিনে ফুটো করে ফেললাম। খালামনিও কোনো দিন তার খবর করেন নি। কেন কে জানে!
(চলবে) লন্ডন ৩০ জুন ২০২১
শামীম আজাদ : কবি, লেখক ও সংগঠক