আজ রুহিয়ার রামনাথ হাটের গণহত্যা দিবস

রুহিয়ার রামনাথ হাটের গণকবর। ছবি : আপেল মাহমুদ, রুহিয়া, ঠাকুরগাঁও।
আজ ৮ আগস্ট। রুহিয়া রামনাথ হাট গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে রুহিয়ার ইউনিয়নের কানিকাশালগাঁওয়ের ৬জনকে ধরে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর আলশামস বাহিনী ও রাজাকারদের সহযোগিতায় নির্মমভাবে হত্যা করে।
১৯৭১ সালের ৭ আগস্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা রুহিয়া ইউনিয়নের কানিকোশালগাঁও গ্রাম থেকে ৬ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে ধরে রামনাথ হাটের নুরুল ইসলামের বাড়িতে নিয়ে যায়। ঠাকুরগাঁও দখল করার পর এই বাড়িতেও পাকিস্তানি সেনাছাউনি স্থাপন করা হয়েছিল। নুরুল ইসলামের ছোট ভাই ভাষাসংগ্রামী ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ফজলুল করিম ঠাকুরগাঁও-১ আসনে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ১৯৭১ সালে ঠাকুরগাঁওয়ের সংগ্রাম কমিটির আহ্বান ছিলেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি ছিল কানিকোশালগাঁওয়ে। আওয়ামী লীগের এই নেতার আত্মীয় হওয়ার সুবাদে স্থানীয় আলশামস বাহিনী ও রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সৈন্যরা ৬ জন নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়।
স্থানীয় আলশামস বাহিনী ও রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সৈন্যরা ৬ জন নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়।
এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানা যায় যে, ১৯৭১ সালের ৭ আগস্ট রাতে পাকিস্তানিদের দোসর আলশামস নেতা তাজিম খান আরও ৫ সদস্যকে নিয়ে এলাকার শান্তিপ্রিয় মানুষ আবুল কাশেম মো. রফিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে রামনাথ হাটে পাকিস্তানি সেনা ছাউনিতে নিয়ে যায়। সেদিনই রাত ৮টার সময় তাজিম খান কয়েকজন সহযোগী ও প্রায় ২৫ জন পাকিস্তানি সৈন্যকে সঙ্গে নিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে আজিম উদ্দিনের বাড়ি ঘেরাও করে প্রথমে আজিম উদ্দিনের স্ত্রীর ঘরে প্রবেশ করে। পাকিস্তানি সৈন্যদের আগমনের খবর পেয়ে বাড়ির সব নারী, শিশু ও কিশোররা আজিম উদ্দিনের স্ত্রীর ঘরে জড়ো হয়েছিলেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা ওই ঘর থেকে কিশোর রেজাউলকে, বাড়ির অন্যান্য ঘর তল্লাশি করে আজিম উদ্দিন ও আরও ৪ জনকে ধরে সেনাছাউনিতে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের সারারাত অমানুষিক নির্যাতনের পর ৮ আগস্ট তাদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। পরে তাদের লাশগুলো রামনাথ হাট সেনাছাউনির পাশে অর্থাৎ এমপিএ ফজলুল করিমের বড় ভাই নুরুল ইসলামের বাড়ির আঙিনায় গর্ত করে মাটি চাপা দেয়া হয়।
শহীদ আবুল কাশেম মো. রফিকুল ইসলামের ছেলে মো. তৌফিকুল ইসলাম (মুক্তিযুদ্ধকালীন বয়স ছিল ১৩ বছর) জানান, যুদ্ধের সময় তার চাচারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতাও মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতে গমন করেন এবং প্রশিক্ষণ শেষে স্ত্রীকে দেখার জন্য স্বল্প সময়ের জন্য বাড়িতে আসেন। তাজিম খানকে এক সময় আবুল কাশেম বলেছিলেন যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই এবং বিশ্বের কোনো শক্তি বাংলার জনগণকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। সেই কথা মনে রেখে তাজিম খান সব সময় আবুল কাশেমের গতিবিধি ও কর্মকাণ্ডের তথ্য সংগ্রহের জন্য সচেষ্ট ছিল। তাজিম খান তার চরদের মাধ্যমে জানতে পেরেছিল যে, আবুল কাশেম রাতের অন্ধকারে বাড়িতে এসেছেন। এই খবর পেয়েই সে তৎক্ষণাৎ পাকিস্তানি সেনা ছাউনিতে গিয়ে সৈন্যদের নিয়ে আবুল কাশেমের বাড়ি ঘেরাও করে তাকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর তারা আবুল কাশেমকে রামনাথ হাট সেনাছাউনিতে নিয়ে যায় এবং পরদিন সকালেই তাকে হত্যা করে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি এলাকাবাসী নুরুল ইসলামের বাড়িতে স্থাপিত পাকিস্তানি সেনাছাউনির আঙিনা খনন করে অনেক মানুষের গলিত ও বিকৃত লাশ উত্তোলন করেন। পরনের কাপড় ও জুতা দেখে আত্মীয়স্বজনরা শহীদদের লাশ শনাক্ত করেন। পরে যথাযোগ্য মর্যাদায় নুরুল ইসলামের বাড়ির সামনেই তাদের লাশ দাফন করা হয়। পরিবারের সদস্যরা শহীদদের কবরগুলো পাকা করেছেন, কিন্তু কবরের দেয়ালে শহীদদের শাহাদতের ঘটনা লিপিবদ্ধ করা হয়নি। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ অবগত করার জন্য শহীদদের নাম ও শাহাদতের ঘটনা লিপিবদ্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন।
১৯৭১ সালের ৮ আগস্ট রামনাথ হাট পাকিস্তানি সেনাছাউনিতে যে ৬ জনকে নির্মমভাবে হত্যার পর মাটি চাপা দেয়া হয়েছিল তাদের নাম নিম্নে উল্লেখ করা হলো : শহিদ আজিম উদ্দিন আহমেদ, শহিদ আবুল কাশেম, মো. রফিকুল ইসলাম, শহীদ আবুল মনসুর, মো. রেজাউল ইসলাম, শহীদ দেলোয়ার হোসেন, শহীদ মো. বেলাল হোসেন (বেলু), শহীদ মো. জালাল। উল্লেখ্য, ৬ জন শহীদ সবাই একে অপরের আত্মীয় ছিলেন।
১৯৭১ সালের ৮ আগস্ট রামনাথ হাট পাকিস্তানি সেনাছাউনিতে যে ৬ জনকে নির্মমভাবে হত্যার পর মাটি চাপা দেয়া হয়েছিল তাদের নাম হলো : শহীদ আজিম উদ্দিন আহমেদ, শহীদ আবুল কাশেম, মো. রফিকুল ইসলাম, শহীদ আবুল মনসুর, মো. রেজাউল ইসলাম, শহীদ দেলোয়ার হোসেন, শহীদ মো. বেলাল হোসেন (বেলু), শহীদ মো. জালাল। উল্লেখ্য, ৬ জন শহীদ সবাই একে অপরের আত্মীয় ছিলেন।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাত থেকে ক্যাপটেন নাবিদ আলমের নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঠাকুরগাঁও এলাকায় নিরীহ বাঙালি জনগণকে হত্যা করতে শুরু করে।
তথ্যসূত্র : লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির, বীরপ্রতীক