সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘একটি চিঠি’

‘সুনীল’ মানে একটি সু-বিশাল সাহিত্যভাণ্ডার।দুই বাংলার কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক, কবি, সংবাদিক ও সম্পাদক। ‘পূর্ব-পশ্চিম’‘সেই সময়’ ‘প্রথম আলো’ কিংবা ‘একা এবং কয়েকজন’ এই উপন্যাসগুলোর নাম শুনেননি এমন কাউকে পাওয়া যাবে কি না বলা মুশকিল। মাদারীপুরের কালকিনির মাইজপাড়ার চার বছরের সুনীল একদিন নিজ গ্রামে ছেড়ে কলকাতা শহরে হেতু করেন। সেই গ্রামের স্মৃতি তিনি যে কখনো ভুলেননি- তা তাঁর আত্মজীবনী ‘অর্ধেক জীবন’ কিংবা বিখ্যাত উপন্যাস ‘পূর্ব-পশ্চিম’ খুঁজে পাওয়া যায়। জীবদ্দশায় তিনি নিজ গ্রামকে খুঁজে বের করেন।যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী ও তার সাহিত্য অনুরাগী আবদুর রাজ্জাক হাওলাদারে মাধ্যমে। তিনি সুনীলকে খুঁজে দেন তাঁর পৈতৃকভিটা। তা দেখে তিনি আবেগে কেঁদে ফেলেন। কয়েকবার তিনি এই গ্রামে এসেছেন। বাড়িতে দাঁড়িয়ে প্রশান্তিতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছেন।
ছোট সুনীল কলকাতায় এসে শুরু করেন পড়াশোনা। বাবা স্কুল শিক্ষক। অভাব অনটনের সংসার। ছেলে যাতে এই অভাবের সংসারে বখে না যায়, তার জন্য তিনি ধরিয়ে দেন প্রখ্যাত বৃটিশ কবি আলফ্রেড লর্ড টেনিসনের একটি কাব্যগ্রন্থ অনুবাদের জন্য। বাবা কালীপদ গঙ্গোপাধ্যায় ছেলেকে বলে, প্রতিদিন এখান থেকে দু’টি করে কবিতা অনুবাদ করবে।’ ব্যস শুরু করে দিলেন অনুবাদের কাজ। ঘরে বসে বসে পড়াশোনা, অনুবাদের কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। কখনো সখনো মন খারাপ হত বন্ধুদের সঙ্গে দিব্যি আড্ডা না দেওয়া কিংবা সিনেমা দেখতে না যেতে পারাই।
ছেলে যাতে এই অভাবের সংসারে বখে না যায়, তার জন্য তিনি ধরিয়ে দেন প্রখ্যাত বৃটিশ কবি আলফ্রেড লর্ড টেনিসনের একটি কাব্যগ্রন্থ অনুবাদের জন্য। বাবা কালীপদ গঙ্গোপাধ্যায় ছেলেকে বলে, প্রতিদিন এখান থেকে দু’টি করে কবিতা অনুবাদ করবে।’

অনু্বাদ করতে করতে তিনি নিজেও একদিন লিখলেন একটি কবিতা। ঘটনাটা ঘটল এভাবে, স্কুলপড়ুয়া সুনীলের পরীক্ষা শেষ। তাঁর এক বান্ধবীকে উদ্দেশ্য করে লিখতে বসলেন। কল্পনার জগত জুড়ে সেই বান্ধবী। লিখলেন-
একটি চিঠি
বলাকা তোমার শুভ্র চোখেতে পায়নি ঘুম ?
জানোনা কি এটা কুয়াশায় ঢাকা
রাত নিঝুম !
স্বপ্ন দেখো না ? এখনো কি তার
সময় নয় ?
বলাকা, তুমি কি পেয়েছো ভয় ?
জানো নাকি আমি পথে ঘুরে-ঘুরে দিশেহারা-
আকাশের মায়া গান গেয়ে করে
গৃহছাড়া।
তোমার বাশিতে ফুঁ দিয়েছি আমি
সেই ধ্বনি-
বলাকা এই কি জাগরণী ?
মরু পর্বতে ঘুর্ণিঝড় যে হোল শুরু ।
আকাশের বুকে মেঘশিশুদের
গুরু গুরু।
হিংস্র নখর এখনো লুকোয় বাকে-বাকে
সরল কুমারী বোকা চোখে শুধু
চেয়ে থাকে ।
সমুদ্র-ঝড় আসেনি এখনো মনে-মনে ?
বলাকা-হৃদয় এখনও কি শুধু দিন গোনে ।
মন উত্তাল পাখি শুধু ডাকে বোবা যুগে ,
ফেরারী বাহিনী বছর কাটায়
উদ্যোগে ।
মনের সূর্য তবুও ভাংবে অন্ধ ঘোর
বলাকা, তুমি কি দেখনি ভোর ?
হৃদয় জাগানো পরশমণির সন্ধানেই
তাই তো অলস দুপুর যাপনে
শঙ্কা নেই ।
স্বপ্ন-সাগরে দিয়েছি নিজেকে
বিসর্জন
বলাকা, তোমার গ্রন্থি হবেনা উন্মোচন ?
(সুনীলদার প্রথম প্রকাশিত কবিতা, দেশ, ৩১শে মার্চ ১৯৫১)
লেখা শেষ করে পাঠিয়ে দিলেন পত্রিকা অফিসে। কবিতাটি ছাপা হলো। তারপর একদিন পত্রিকা অফিস থেকে বাড়ির ঠিকানায় পোঁছাল একটি ভারি খাম। খামের উপরে লেখা ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়’। বিশ্বাস হচ্ছিল না যে তার নামে খাম আসবে। খাম খুলে দেখেন ‘১৯৫১ সালের ৩১ মার্চ সংখ্যা ‘দেশ’ পত্রিকায় তার লেখা কবিতাটি ছাপা হয়েছে।’ নিজের চোখ বিশ্বাস করতে পারছিল না। তার আশপাশেও কেউ না। এমনি যে বান্ধবীকে নিয়ে লেখা কবিতা তিনিও বিশ্বাস করলে না।
এভাবে ‘সুনীল’ একদিন ধীরে ধীরে প্রখ্যাত কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হয়ে ওঠলেন।
আরও পড়ুন:
ভূবনভাঙার মেঘলা আকাশ
বাংলা সাহিত্যে এখনো অপ্রতিদ্বন্দ্বী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ৮৭তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর জীবনকর্ম নিয়ে মিতালী সরকারের নিবেদন