সুরক্ষা বিধিতেই পালন করি সম্প্রীতির রাখি বন্ধন

আজ ২২ আগস্ট।পঞ্জিকা অনুযায়ী প্রত্যেক বছর শ্রাবণ মাসে পালিত হয় এই উৎসব।সাধারণত এই দিনে ভাই বা দাদাদের হাতে বোনেরা রাখি বাঁধে। একইসঙ্গে বোন বা দিদিকে সারা জীবন আগলে রাখার প্রতিশ্রুতি দেয় ভাইয়েরা। এই উৎসব ভাই-বোনের সম্পর্ককে আরও গাঢ় করতে সাহায্য করে।সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, ভালোবাসার, বাঙালি আবেগের পরম প্রিয় রাখি বন্ধন। প্রবাদে আছে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। উৎসবমুখর বাঙালি তার সংস্কৃতি ঐতিহ্য পরম্পরা কৃষ্টিকে এখনো বেঁচে আছে। শতাব্দী প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে জনজীবন বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত, বিপন্ন, সংক্ষিপ্ত। তবুও মানুষ উৎসবের পরশে ভুলে গিয়েছে অতিমারি বীভৎসতা, যন্ত্রণা। এখানে উৎসবের মাহাত্ম্য প্রসঙ্গিকতা ।আমরা বাঙালিরা রাখীবন্ধন উৎসবকে কেবলই ভাই বোনের মধ্যে আবদ্ধ রাখিনি। ধর্মীয় রাজনৈতিক গন্ডি পেরিয়ে ,রাখীকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জায়গা দিয়েছে বাঙালিই।
বাংলায় রাখি বন্ধন প্রবর্তন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে। উনিশ শতকে আমাদের বাংলায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চরম পর্যায়ে ছিল। যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছে অপরিমিত ভয়ের কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয় তারা বাংলাকে দুই ভাগে ভাগ করবে। আজ থেকে ঠিক ১১৫ বছর পূর্বে ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর তৎকালীন ইংরেজ শাসক বাংলা প্রেসিডেন্সি ভৌগোলিক সীমানার বিস্তারিত ভূখণ্ডের তথা বিশালত্বের যুক্তি দেখিয়ে বাংলাকে ভাগ করার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করেছিল।
ঐক্যবদ্ধ সমগ্র বাঙালির রাজনৈতিক বিরোধিতা কে দুর্বল করার একটা ঘৃণ্য চক্রান্ত বলেই তাদের মনে হয়েছিল এই বঙ্গভঙ্গ। ফলস্বরূপ বিভিন্ন বাঙালি সম্প্রদায় ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশের বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিল দুর্বার ভাবে। ১৮৯০ এর দশকের দুর্ভিক্ষ মানুষের অর্থনৈতিক দুরবস্থা চরম নিয়ে গেছিল। সেই অবস্থায় সরকারের বাংলা বিভাজন মানুষের ক্ষোভে আরও ইন্ধন যুক্ত করেছিল। একটি পুরোপুরি রাজনৈতিক আন্দোলনে এইভাবে সামাজিক বিষয় যুক্ত হয়ে স্বদেশী আন্দোলনের রুপ দিয়েছিল। কিন্তু নানাবিধ কারণে সেই আন্দোলন গণআন্দোলনের শিখরে পৌঁছাতে পারেনি। আন্দোলনের নেতৃত্বে শহরের শিক্ষিত সম্প্রদায় ঢাকায় আমজনতার উপযোগী কর্মসূচি গৃহীত হয়নি।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করতে রাখিকে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই বছরের ২০ জুলাই সরকার বঙ্গভঙ্গের কথা ঘোষণা করেন। জানানো হয় এই আইন কার্যকর হবে ১৯০৫ এর ১৬ অক্টোবর, বাংলায় ৩০ আশ্বিন।সেই সময় জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতায় মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে শামিল হয়। ঠিক হয় ওই দিনে বাংলায় মানুষ পরস্পরের হাতে বেঁধে দেবেন হলুদ সুতলি।বলাই বাহুল্য সেটা রাখি পূর্ণিমার দিন ছিল না।সকালবেলা পায়ে হেঁটে সবাই গেলেন জগন্নাথ ঘাটে। রাস্তার দু দিকে বাড়ির ছাদ ,ফুটপাত লোকে লোকারণ্য। মেয়েরা খই ছড়াচ্ছে। শঙ্খ বাজাচ্ছে।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গাইতে গাইতে মিছিল চলল ঘাটের দিকে। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ,অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এরাও সঙ্গে ছিলেন। গঙ্গায় জমায়েত হয়ে মনিব চাকর সবাই একসঙ্গে স্থান করলেন। সঙ্গে ছিল অনেক রাখি।সানির পর একে অপরকে রাখি পরালেন যাকে সামনে পাওয়া যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও বাকিরা তার হাতে বিদায় দিচ্ছেন রাখি। ছেলে মেয়ে কেউ বাদ যাচ্ছে না। সেদিন বিকেলে জনসভা হলো কলকাতায়। ৫০-৭০ হাজার লোকের বিপুল সমাবেশে ভাষণ দিলেন আনন্দমোহন বসু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত সর্বভারতীয় নেতারা।
এই দিনকে মিলন দিবস রূপে পালন করা হয়। এ ধর্মের মানুষ ভালোবেসে জড়িয়ে ধরে হাতে রাখি পরিয়ে দিচ্ছে যার হাতে তার ধর্ম আলাদা। হাতে হাত রেখে, সাম্য ,ঐক্য ,সম্প্রীতির আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে, অদম্য মনোবল ও মানসিকতায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অভিমুখী ছুঁড়ে দেওয়া হলো প্রতীকী তীব্র প্রতিবাদ। একটা মানুষের ডাকেই ধর্ম নির্বিশেষে সারা বাংলা এক সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিল সেদিন।
এই দিনকে মিলন দিবস রূপে পালন করা হয়। এ ধর্মের মানুষ ভালোবেসে জড়িয়ে ধরে হাতে রাখি পরিয়ে দিচ্ছে যার হাতে তার ধর্ম আলাদা। হাতে হাত রেখে, সাম্য ,ঐক্য ,সম্প্রীতির আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে, অদম্য মনোবল ও মানসিকতায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অভিমুখী ছুঁড়ে দেওয়া হলো প্রতীকী তীব্র প্রতিবাদ। একটা মানুষের ডাকেই ধর্ম নির্বিশেষে সারা বাংলা এক সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিল সেদিন।
প্রতিবাদের ভাষা চরিত্র বদলেছে ক্রমশ।ভাইসরয় লর্ড কার্জন বা ব্রিটিশ সরকার ভাবতেই পারেনি গণআন্দোলন এত সুদুরপ্রসারী হবে।দীর্ঘ প্রতিবাদ প্রতিরোধে শেষ পর্যন্ত ইংরেজ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করেন ।দীর্ঘ ৬ বছর পর১৯১১ সালে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ রদ করেন বাংলা ভাগের প্রস্তাব। এরপর ইংরেজ সরকার বাঙালিদের কাজকর্মে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বঙ্গভঙ্গ রদ করে রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করেন।। বাংলা আবার একত্রিত হয়।কবিগুরু এই দিনটিকে রাখি বন্ধন উৎসব পালন করার ডাক দেন ।
বাংলায় হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্বকে ফুটিয়ে তুলতে ও পুনঃজাগ্রত করতে এই উদ্যোগ নেন রবীন্দ্রনাথ কিন্তু সেই রাখি বন্ধন উৎসব শ্রাবণ মাসে বা পূর্ণিমা কোনোটাতেই হয়নি। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশ নিয়ে বিজয় সম্মেলন নামক এক ভাষণও রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন।
কলকাতার উপকণ্ঠে প্রখ্যাত নাখোদা মসজিদের উপস্থিত হয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ মসজিদের মুসল্লিদের হাতে রাখি বেঁধে দেন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের ব্যাপকতায় ব্রিটিশ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের পথ উন্মুক্ত করে।শুধু বোনেরা নয় এই দিন প্রত্যেক মানুষের মধ্যে একতাই ছিল রাখি বন্ধনের মূল বিষয়। এই রাখি বন্ধন উৎসবে সম্প্রীতি যেভাবে জায়গা করে নিয়েছিল তা আজকের দিনে ও প্রাসঙ্গিক ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
রবীন্দ্রনাথ এই রাখি বন্ধন উৎসব নিয়ে এই গান লিখেছিলেন—‘বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার ফল।পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক, হে ভগবান।’ মূল উদ্দেশ্যই ছিল মানবিকতা, সম্প্রীতি ও একতা। সে দিক থেকে বিচার করে বলতে গেলে রাখি বন্ধন একটি ধর্মনিরপেক্ষ মিলনোৎসব। এই রাখি বন্ধন উৎসব মূলত ভাই বোনের বন্ধন ও ভালোবাসার সম্পর্ককে উৎসাহিত, পুনঃজাগ্রত করার উৎসব।
এই দিনটি একে অপরের প্রতি আরও দায়বদ্ধ হওয়ার দিন। এমনিতেই সোশ্যাল মিডিয়ার দাপটে রাখি এখন অনেকটা কোণঠাসা। কিন্তু তবু রাখির একটা গুরুত্ব আছে। রাখির সঙ্গে সম্পৃক্ত ও পরতে পরতে জুড়ে আছে আবেগ ,ভালোবাসা। করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে রাখি উৎসব এবার ঘটা করে পালিত হবে না। কিন্তু এবার যেন অতিমারির নিদারুণ আবহে সব উলটপালট হয়ে গেছে। এই পৃথিবীর সমস্ত কিছুই একে অপরের সঙ্গে এক নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ। উৎসবের মূলমন্ত্র হল মিলনের মন্ত্র, ঐক্যের, সম্প্রীতির সুর।
পৃথিবীর সমস্ত কিছুই একে অপরের সঙ্গে এক নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ। উৎসবের মূলমন্ত্র হল মিলনের মন্ত্র, ঐক্যের, সম্প্রীতির সুর।
বর্তমান দেশ ভক্তির নামে যেভাবে উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে সম্প্রীতির চিরায়ত বুনোটকে ক্ষতবিক্ষত করে চলেছে, কায়েমী স্বার্থে পূরণে বিভাজন ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিচ্ছে, প্রতিনিয়ত মানবতা ,সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, সৌজন্যবোধকে গলা টিপে ধরছে, তৎসহ করোনা অতিমারির সংকটে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো মানবতা চরমভাবে বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত, ঠিক সেই বাস্তবিক প্রেক্ষাপটেই আমাদের প্রত্যেকের কাছেই একমাত্র মহামিলনের বার্তা, শাশ্বত বাণী নিয়ে আসতে পারে এই সম্প্রীতির রাখি বন্ধন উৎসব। এই নিদারুণ সংকটকালে আমরা সবাই পারস্পরিক দূরত্ব, স্বাস্থ্যবিধি, বিধি নিষেধ, প্রশাসনিক রীতিনীতি ও মুখাবরণ পরে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সম্প্রীতির চিরায়ত স্রোতে ভেসে গিয়ে এই রাখি বন্ধন উৎসব পালন করি এবং তার আবহমান আদর্শকে মননে স্মরণ করি। তবেই এই মহামিলনের উৎসব হয়ে উঠবে পরিপূর্ণ প্রাসঙ্গিক, চিরন্তন, শাশ্বত এবং সময়োপযোগী।
আসন্ন রাখি উৎসবে আমরা সুরক্ষা বিধি মেনেই একে অপরের হাতে করে দিই সম্প্রীতির, ভালোবাসার, আনন্দের, সুস্থতার রাখি। এভাবেই রাখি উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে বাড়িয়ে দিই একে অপরের প্রতি সহযোগিতা, সহমর্মিতা। করোনাকালে গড়ে উঠুক আমাদের মধ্যে মানবতা। দূর হয়ে যাক বিদ্বেষ, বিভাজন, দৈন্যতা, অসারতা, অস্থিরতা,সাম্প্রদায়িকতা। সর্বোপরি আমরা সবাই রাখি উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে হয়ে উঠি আরো বেশি মানবিক, সহনশীল, উদারচেতা, প্রকৃত মানুষ।