অস্থির চলাচল পৃথিবীতে রাখিবন্ধন উৎসবের তাৎপর্য

সারা দেশজুড়ে রাখিবন্ধন উৎসব পালিত হচ্ছে। যদিও করোনার আবহে এই বছর উৎসবের রং কিছুটা ফিকে। এই উৎসব ভাই ও বোনের মধ্যে প্রীতিবন্ধনের উৎসব।এই দিন দিদি বা বোনেরা তাদের ভাই বা দাদার হাতে রাখি নামে একটি পবিত্র সুতো বেঁধে দেয়। এই রাখিটি ভাই বা দাদার প্রতি দিদি বা বোনের ভালোবাসা ও ভাইয়ের মঙ্গলকামনা এবং দিদি বা বোনকে আজীবন রক্ষা করার ভাই বা দাদার শপথের প্রতীক। শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এই উৎসব উদযাপিত হয়।
রাখিপূর্ণিমা ও ঝুলন যাত্রা
শ্রীকৃষ্ণের দ্বাদশ যাত্রার অন্যতম ঝুলন যাত্রা।দ্বাপর যুগে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলাকে কেন্দ্র করে ঝুলন উৎসব এর সূচনা হয়েছিল। ঝুলন শব্দটি এসেছে হিন্দির ঝুলা অর্থাৎ দোলনা থেকে। ঝুলন উৎসব কে ঘিরে রয়েছে নানা আচার-অনুষ্ঠান। তার মধ্যে অন্যতম হল দোলনায় রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি স্থাপন করে দোলানো।শ্রাবণ মাসের শুক্লা দ্বাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত পাঁচ দিন ধরে চলে ঝুলন উৎসব। শ্রাবণী পূর্ণিমাকে তাই ঝুলন পূর্ণিমাও বলা হয়। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার যে যুগল মূর্তি, তাকে কল্পনা করেই বৈষ্ণবদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই উৎসব। মথুরা-বৃন্দাবনে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই উৎসবে সামিল হন। বাংলাতেও ঝুলন উৎসব এর ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। বিভিন্ন মঠ মন্দিরে তো বটেই বাড়িতেও ধুমধাম করে ঝুলন উৎসব পালন করা হয়। বহু জায়গায় চলে হরিনাম সংকীর্তন। ঠাকুরকে নানা ধরনের ফল, মিষ্টি, লুচি ও সুজি দিয়ে ভোগ দেওয়া হয়।
ধর্মীয় আচার এর পাশাপাশি সামাজিকভাবেও এই উৎসবের একটা বড় গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষ করে ছোটরা নানা ধরনের পুতুল, গাছপালা, নুড়ি পাথর দিয়ে ঝুলন সাজায়। প্রতিটি সাজানোর মধ্যে একটা গল্প থাকে। সেখানে যেমন শ্রীকৃষ্ণের লীলাকে কেন্দ্র করে নানা গল্প থাকে, যেমন কালিয় দমন, বক রাক্ষস বধ,পুতনা বধ প্রভৃতি তেমনই আবার আধুনিক গ্রাম, শহর, পাহাড়, নদী এসব দিয়েও সাজানোর রীতি রয়েছে।পাঁচ দিনব্যাপী ঝুলন যাত্রার শেষ দিন হল ঝুলন পূর্ণিমা। ঝুলন পূর্ণিমার আরেক সামাজিক দিক হল রাখিবন্ধন। তাই অনেকে একে রাখি পূর্ণিমা বলেন। ঘরে ঘরে ভাইয়ের হাতে রাখি পরিয়ে দেন বোনরা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রাখিবন্ধন
আর এই রাখিবন্ধনকে হাতিয়ার করে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সালটা ১৯০৫। ১৯ জুলাই ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব ঘোষণা করলেন। ১৯০৫ সালের আগস্ট মাসে বঙ্গভঙ্গ জন্য আইন পাস করা হয়।
ব্রিটিশদের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলায় যে জাতীয়তাবাদী ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠছে বাংলা ভাগের মাধ্যমে তাকে প্রতিহত করা। এই কাজে তারা ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিভাজন কে হাতিয়ার করতে চেয়েছিল। কিন্তু এর ফল হল উল্টো। সময়টা শ্রাবণ মাস। কিছুদিনের মধ্যেই বাংলার ঘরে ঘরে রাখিবন্ধন পালন করবে ভাইবোনেরা।
রবীন্দ্রনাথ সেই পরম্পরাকে হাতিয়ার করে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির বার্তা দিতে রাখিবন্ধন কর্মসূচির ডাক দিলেন। কোনো রাজনৈতিক বা বৈপ্লবিক দলের ডাকে নয় একজন কবির ডাকে গোটা বাংলা স্তব্ধ হয়ে গেল। মূল শোভাযাত্রার পুরোভাগে নেতৃত্ব দিলেন স্বয়ং বিশ্বকবি। তাঁর কণ্ঠে তখন সেই গান বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুণ্য হোক, পুণ্য হোক, পুণ্য হোক হে ভগবান। বাংলার ঘরে ঘরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদ্দেশ্যে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে একে অপরের হাতে রাখি পরিয়ে ভ্রাতৃত্বের বার্তা দিল বাংলা। এক ধর্মীয় আচারকে সামাজিক আন্দোলনের হাতিয়ারে পরিণত করলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই আন্দোলন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলল।রবীন্দ্রনাথ রাখির সুতোয় যে সম্প্রীতির বার্তা গেঁথে দিলেন তাকে ধরে রাখার উত্তর দায়িত্ব প্রতিটি বাঙালির।
ঐতিহাসিক রাখিবন্ধন
৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রীক বীর আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করলে আলেকজান্ডারের স্ত্রী রোজানা রাজা পুরুকে একটি পবিত্র সুতো পাঠিয়ে তাঁকে অনুরোধ করেন আলেকজান্ডারের ক্ষতি না করার জন্য। পুরু ছিলেন কাটোচ রাজা। তিনি রাখীকে সম্মান করতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি নিজে আলেকজান্ডারকে আঘাত করেননি।
রানি কর্ণবতী ও সম্রাট হুমায়ুন
একটি জনপ্রিয় গল্প অনুযায়ী, চিতোরের রানি কর্ণবতী ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে একটি রাখি পাঠান। গুজরাতের সুলতান বাহাদুর শাহ চিতোর আক্রমণ করলে বিধবা রানি কর্ণবতী অসহায় বোধ করেন এবং তিনি হুমায়ুনকে একটি রাখি পাঠিয়ে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করেন। কর্ণবতীর রাখি প্রেরণে অভিভূত হয়ে হুমায়ুন চিতোর রক্ষা করার জন্য সৈন্য প্রেরণ করেন। তবে হুমায়ুনের সেনা পাঠাতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। বাহাদুর শাহ রানির দুর্গ জয় করে নিয়েছিলেন। শোনা যায়, বাহাদুর শাহের সেনাবাহিনীর হাত থেকে সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য ১৫৩৫ সালের ৮ মার্চ রানি কর্ণবতী ১৩,০০০ পুরস্ত্রীকে নিয়ে জহর ব্রত পালন করে আগুনে আত্মাহুতি দেন। চিতোরে পৌঁছে হুমায়ুন বাহাদুর শাহকে দুর্গ থেকে উৎখাত করেন এবং কর্ণবতীর ছেলে বিক্রমজিৎ সিংকে সিংহাসনে বসান। সমসাময়িক ঐতিহাসিকদের লেখা থেকে রাখি প্রেরণের কথা অবশ্য জানা যায় না। কোনো কোনো ঐতিহাসিক রাখি পাঠানোর গল্পটির সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করেন। তবে মধ্য-সপ্তদশ শতকের রাজস্থানী লোকগাথায় এর উল্লেখ পাওয়া যায়।
পৌরাণিক রাখিবন্ধন
রাখি পূর্ণিমাকে ঘিরে রয়েছে নানান পৌরাণিক কাহিনি। রামায়ণ অনুযায়ী, ভগবান রাম সমস্ত বানর সেনাদের ফুল দিয়ে রাখি বেঁধে ছিলেন। এছাড়া, লক্ষ্মী বলিকে ভাই হিসেবে মেনে রাখি পরিয়েছিলেন যাতে সে উপহার স্বরূপ বিষ্ণুকে স্বর্গে তার কাছে ফিরে যেতে বলে।
অন্যদিকে, সুভদ্রা কৃষ্ণের ছোট বোন, কৃষ্ণ সুভদ্রাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তবে আপন বোন না হয়েও দ্রৌপদী ছিলেন কৃষ্ণের অতীব স্নেহভাজন। একদিন সুভদ্রা কিছুটা অভিমান ভরে কৃষ্ণকে প্রশ্ন করেন, এর কারণ কী। উত্তরে কৃষ্ণ জানান, ‘যথা সময়ে এর কারন তুমি বুঝতে ‘এর কিছুদিন পর শ্রীকৃষ্ণের হাত কেটে রক্ত ঝরছিল, তা দেখে সুভদ্রা রক্ত বন্ধ করার জন্য কাপড় খুঁজছিলেন, কিন্তু কোথাও কোনো পাতলা সাধারণ কাপড় পাচ্ছিলেন না, এর মাঝে দ্রৌপদী সেখানে এসে দেখেন কৃষ্ণের হাত থেকে গলগ করে রক্ত পড়ছে। সেই ঘটনা দেখামাত্রই বিন্দুমাত্র দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে নিজের মুল্যবান রেশম শাড়ি ছিঁড়ে কৃষ্ণের হাত বেধে দেন, কিছুক্ষণ পর রক্তপাত বন্ধ হয়। তখন শ্রীকৃষ্ণ বোন সুভদ্রাকে ডেকে বলেন—‘এখন বুঝতে পেরেছ কেন আমি দ্রৌপদীকে এত স্নেহ করি?’ সুভদ্রা তখন বুঝত পারলেন, ভক্তি ও পবিত্র ভালবাসা, শ্রদ্ধা কী জিনিস! দাদা কৃষ্ণের চেয়ে মুল্যবান বস্ত্র নিজের কাছে বেশি প্রিয়, এটা ভেবে সুভদ্রা দারুণ লজ্জিত হয়ে পড়েন। কোনো বোন তার ভাইয়ের কোনও রকম কষ্ট, অমঙ্গল সহ্য করতে পারে না। ভাইয়ের কষ্ট দুর করার জন্য সে সর্বত্তম চেষ্টা করে। অন্যদিকে ভাই ও তার বোনকে পৃথিবীতে সর্বাধিক স্নেহ করে, সারাজীবন তাঁকে রক্ষা করে থাকে, যে রকম শ্রীকৃষ্ণ দ্রৌপদীকে রাজসভায় চরম কলঙ্ক থেকে রক্ষা করেছিলেন। তাই, এই পবিত্র বন্ধনের দিনে, সকল ভাই-বোনের উচিত এরকম ভক্তিভাব ও ভালোবাসা বজায় রাখা।
কৃত্রিমতা, যান্ত্রিকতার এই বর্তমান যুগে ভাই-বোনের মাঝে ভালবাসা ও শ্রদ্ধার বড় অভাব। সনাতন ধর্মে বড় বোন বা দিদিকে মাতৃস্থানীয় এবং বড় ভাইকে পিতৃস্থানীয় সম্মান ও ভালবাসা দেওয়ার কথা বলা আছে।
রাখিবন্ধনের দিন গণেশের বোন গণেশের হাতে একটি রাখি বেঁধে দেন। এতে গণেশের দুই ছেলে শুভ ও লাভের হিংসে হয়। তাদের কোনো বোন ছিল না। তারা বাবার কাছে একটা বোনের বায়না ধরে। গণেশ তখন তাঁর দুই ছেলের সন্তোষ বিধানের জন্য দিব্য আগুন থেকে একটি কন্যার জন্ম দেন। এই দেবী হলেন গণেশের মেয়ে সন্তোষী মা। সন্তোষী মা শুভ ও লাভের হাতে রাখি বেঁধে দেন।
অন্য একটি কাহিনি রয়েছে, দৈত্যরাজা বলি ছিলেন বিষ্ণুর ভক্ত। বিষ্ণু বৈকুণ্ঠ ছেড়ে বালির রাজ্য রক্ষা করতে চলে এসেছিলেন। বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী স্বামীকে ফিরে পাওয়ার জন্য এক সাধারণ মেয়ের ছদ্মবেশে বলিরাজের কাছে আসেন। লক্ষ্মী বলিকে বলেন, তাঁর স্বামী নিরুদ্দেশ। যতদিন না স্বামী ফিরে আসেন, ততদিন যেন বলি তাঁকে আশ্রয় দেন। বলিরাজা ছদ্মবেশী লক্ষ্মীকে আশ্রয় দিতে রাজি হন। শ্রাবণ পূর্ণিমা উৎসবে লক্ষ্মী বলিরাজার হাতে একটি রাখি বেঁধে দেন। বলিরাজা এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে লক্ষ্মী আত্মপরিচয় দিয়ে সব কথা খুলে বলেন। এতে বলিরাজা মুগ্ধ হয়ে বিষ্ণুকে বৈকুণ্ঠে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। বলিরাজা বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেন। সেই থেকে শ্রাবণ পূর্ণিমা তিথিটি বোনেরা রাখিবন্ধন হিসেবে পালন করে।
আজ এই পবিত্র দিনে অস্থির তোলপাড় পৃথিবীতে সম্প্রীতির শান্তিবৃক্ষপাতায় রাখিবন্ধন উৎসব ঘরে ঘরে মৈত্রীর বার্তা বহন করে আনুক এই কামনা করি।
সূত্র : উইকিপিডিয়া, এবিপি আনন্দ, টিভি 9 বাংলা
দীপক সাহা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত