খাদ্যাভ্যাসে অটুট স্বরতন্ত্র : সঙ্গীতে খাদ্যের গুণমান

সঙ্গীতের সঙ্গে সুষম খাদ্যের প্রাচীনকাল থেকে বন্ধুত্ব। লোকসঙ্গীত ও রাগসঙ্গীত এই দুটি সঙ্গীতের মূল ধারায় খাদ্যাভ্যাস ব্যাপক ভূমিকা রাখে। মানুষ মানুষের মেলবন্ধন সৃষ্টিতে সঙ্গীতের এক অনন্য ভূমিকা রয়েছে। সঙ্গীতশিল্পীরা সংস্কৃতির সম্মিলন করার প্রচেষ্টায় সবসময় উত্তমরূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন। শিল্পীদের স্বকীয়তা তুলে ধরার জন্যে খাদ্যাভ্যাসে সজাগ থাকার বিশেষ প্রয়োজন । গলা, জিহ্বা ও আলা জিহ্বার সমম্বিতরূপ স্বরতন্ত্র। এই স্বরতন্ত্র খাদ্যাভ্যাসে অটুট থাকে। অনেক গীতিকার সঙ্গীতের বাণীতে খাদ্যের গুণমানের কথা তুলে ধরেন।
সুললিত কণ্ঠ ধরে রাখার জন্য অনুশীলন যেমন অপরিহার্য, তেমনি যথাযথ খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে সম্পৃক্তির প্রয়োজন রয়েছে। কণ্ঠের মাধুর্য ধরে রাখার জন্য যে সমস্ত খাদ্য গলা এলাকায় এলার্জি সৃষ্টি করে, সেই সমস্ত খাদ্য বর্জন করতে হবে। যেমন: ইলিশ মাছ, চিংড়ি মাছ, গরুর মাংস, খাসির মাংস, হাঁসের মাংস, দুধ ও দুধের তৈরি বিভিন্ন খাদ্য, বেগুন, পুঁই শাক, মিষ্টি কুমড়া, কঁচু ও লতি। এইসব খাদ্যদ্রব্য ভোকাল কর্ডে সমস্যা করে। এমনকি পানি জমে (ইডেমা) এবং ভারি হয়ে যায়। এই অবস্থায় একটু গান গাওয়ার পরে দম ফুরিয়ে যায়। এছাড়াও যে সমস্ত খাদ্যদ্রব্যের দ্বারা ফুসফুসে এলার্জি তৈরি হয়, সেসমস্ত খাদ্রদ্রব্য হাঁপানিভাবও তৈরি করে। যার ফলে দম ফুরিয়ে যায়। এছাড়াও পানীয় এর মধ্যে চা, কফি, সফট ড্রিংক্স্র এবং অন্যান্য খাদ্য (অধিক মসল্লা ও তৈল জাতীয় খাদ্য), কলা, ডাবের পানি প্রভৃতি অতিরিক্ত পেটের গ্যাস তৈরিতে সাহায্য করে। ফলে এই গ্যাস উপর দিকে এসে ঢেকুর সৃষ্টি হয়। তখন ভোকাল কর্ডে প্রদাহ সৃষ্টি করে। ফলে ভোকাল ভারি হয়ে যায় এবং গানের সুর ও লম্বা টানে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়।
ঠান্ডা পানি, পানীয় ও অন্যান্য ঠান্ডা খাবারে (যেমন: আইসক্রীম) গলায় টনসিল ইনফেকশন হয়। এই টনসিল ভোকাল কর্ডে সমস্যা সৃষ্টি করে। যার ফলে কণ্ঠ সাধনা জটিল হয়ে পরে এবং কণ্ঠস্বর বিঘ্নিত হয়ে যেতে পারে।
ভাজা-পোড়া এবং জাঙ্ক ফুড (ফাস্ট ফুড এবং তৈল মসল্লা সমৃদ্ধ খাবার) গলার ক্ষতি করে। ফলশ্রুতিতে গান গাওয়া কঠিন হয়ে পরে।
সুললিত কণ্ঠকে ধরে রাখার ব্যাপারে কিছু পথও রয়েছে। সেই সমস্ত পথগুলো চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। এই বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য শরণাপন্ন হয়েছিলাম আমাদের দেশের স্বনামধন্য নাক, কান ও গলা (ইএনটি) বিশেষজ্ঞ ডা. হারুন-অর-রশিদ মহোদয়ের কাছে। তিনি পরম আন্তরিকতায় তথ্য দিয়ে আমাকে সহযোগিতা করেন। তাঁকে অতল শ্রদ্ধা জানাই। সেসমস্ত সমাধানের পথগুলো :
ক. সবসময় ঠান্ডা পানি ও পানীয় পান থেকে দূরে থাকতে হবে।
খ. ভাজা-পোড়া, অতিরিক্ত তৈল-লবণ-মসল্লা-চিনি এড়িয়ে চলতে হবে।
গ. উচ্চকণ্ঠ কথা বলা বা অতিরিক্ত কথা বলা সামলে চলতে হবে।
ঘ. গলার স্বর ঠিক রাখার জন্য গরম পানির ভাপ মাঝে মাঝে নেওয়া যেতে পারে।
ঙ. প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেতে হবে ।
চ. কণ্ঠশিল্পীকে নিজেই খুঁজে বের করতে হবে কোন কোন খাদ্য খেলে গলা ভেঙে যেতে চায়, চুলকায়, ভারি হয়ে যায়। সেসমস্ত খাদ্যগুলো এড়িয়ে চলতে হবে।১
যাপিত জীবনাচারে সঙ্গীতের বাণীতে খাদ্যের গুণমানের কথা দেখতে পাওয়া যায়। এই গুণমানের কথা প্রচলিত এবং অপ্রচলিত দু‘ধরনের গানেই পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে খাদ্যে গুণমান সম্পৃক্ত প্রাঞ্জল লেখার দুটো অপ্রচলিত গান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গান দুটির রচয়িতা আমাদের দেশের স্বনামধন্য গীতিকবি ও চক্ষু বিশেষজ্ঞ সুপ্রিয়ভাজন ডা. মৃণাল কান্তি ঢালী। গান দুটির সুবাণীতে প্রাণিত হয়েছি।
কবিরাজি পদ্ধতি অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের গাছের পাতার রস সেবনে স্বাস্থ্য ভালো থাকে। আবার স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের পাতা বেটে বড়ি তৈরি করে সেবনের প্রচলনও রয়েছে। ভেষজ সেবনে শরীর সবল হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। সঙ্গীত শিল্পীদের কণ্ঠ সুস্থ রাখার পাশাপাশি পুরো শরীরও সুস্থ রাখার ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। সর্বজন গৃহিত কথায়ই আছে ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’। উদাহরণ হিসেবে প্রাসঙ্গিক একটি গান :
পল্লীগীতি
পাতার রস বটিকা খেলে রোগবালাই সারে
নিম তিতো নিশিন্দা তিতো—
মুখটা হয় যে সবার বিকৃতো—
কালো মেঘের পাতা চিবালে পরে।।
সারায় ব্যাধি খেলে নিমের বড়ি
মেলেরিয়া জ্বরে কালো মেঘের বড়ি
করোলার রসে ডায়বেটিস কমে
সুস্থ সবল থাকবে সবাই ও ভাই
ঔষধী গাছের গুণ জানলে পরে।।
কচি পেয়ারা পাতায় কৃমি দমে
ফুলমদন পাথর কুচিতে আমাশয় সারে।।
থানকুনি রসে পেটের পীড়া সারে
হরতকী বয়রা আমলকী ত্রিফলা রসে
রক্ত রস পরিষ্কার করে ও ভাই
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
ভেষজ সেবনে শরীর সবল করে।।২
সঙ্গীত প্রাণশক্তি জোগায়। তাই মনুষ্যলোকে সঙ্গীত নিজ আসন শক্ত করে নিয়েছে। সঙ্গীত জীবন উদ্ভাসিত করার জন্য সঙ্গীতশিল্পীরা প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যান। সুরের মূচ্ছর্নায় সঙ্গীত হচ্ছে এক অদৃশ্য আলো। যেটা চিত্তের অভ্যন্তরীণ গভীরতায় ঔজ্জ্বল্য ছড়ায়। তাই সঙ্গীতশিল্পীদের সবসময় খাদ্যাভ্যাস অটুট রেখে শরীরের প্রতি বিশেষ যত্ন নেওয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। জন্মান্ধ ব্যতীত সজাগ থাকলে অন্ধ আর হবে না। তাই চোখের আলোয় ভুবনটাকে দেখতে পাবে। হাসি খুশি মনে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করবে। নিয়মিত হাঁটা ও পরিমিত আহারে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকবে। চিনিমুক্ত ভিটামিনযুক্ত খাবার বেশি আহার করলে সঙ্গীতশিল্পীদের সুস্বাস্থ্য দৃঢ় হবে। পানীয় এবং চর্বিযুক্ত খাবার বর্জন করতে হবে। সঙ্গীতশিল্পীদের নিয়মিত স্বাস্থ্য সচেতনে সুস্থ সবল থাকলে তাদের শিল্পচর্চায় ব্যঘাত ঘটবে না। প্রাসঙ্গিক উদাহরণ হিসেবে স্বাস্থ্যবিষয়ক গানটি :
স্বাস্থ্যবিষয়ক গান
হবো না অন্ধ আর ও ভাই দেখবো জগৎ চোখের আলোয়
করবো নিয়ন্ত্রণ উচ্চ রক্তচাপ থাকবো হাস্য উজ্জ্বল
ডায়াবেটিস হলে ও ভাই রক্তের সুগার বাড়ায়
পরিমিত আহার নিয়মিত হাঁটা রাখে স্বাস্থ্য সুস্থ সবল।।
খাবে চিনি মুক্ত ভিটামিন যুক্ত খাবার বেশি পানীয়
করবো পরিহার যত চর্বিযুক্ত খাবার বেশি শ্বাসাল
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা চল্লিশ উর্ধ্বে একান্ত প্রয়োজনীয়
হবো সবাই স্বাস্থ্য সচেতন থাকবো সুস্থ সবল।।
কড লিভার অয়েল ডিমের কুসুম মলা-ঢেলায়
সবুজ শাকসব্জি আর যত হলুদ ফলমুল
রয়েছে ও ভাই ভিটামিন এ প্রচুর যেথায়
শিশুর খাদ্যে থাকবে ওসব রাখতে সুস্থ সবল।।৩
সঙ্গীতশিল্পীদের সুষম খাদ্য পরিমিত আহার করার জন্য সুনামধন্য দু‘জন চিকিৎসক তাঁদের বিশেষ মত প্রকাশ করেন। ডা. হারুন-অর-রশিদ এবং ডা. মৃণাল কান্তি ঢালী‘র মতে সঙ্গীতশিল্পীদের ভাবশুদ্ধির পরিচয় মেলে। পরোপচিকীর্ষার রূপটি চিত্রিত হয়েছে। তাঁদের মতের মাধ্যমে মনোজগতে সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব রয়েছে অনুধাবন করা যায়। মত দুটি :
প্রথমত : ‘খাদ্যাভ্যাস জ্ঞান হোক সঠিক
স্বর ও সুর ছড়াক চারদিক’।৪
দ্বিতীয়ত : ‘ললিত খাদ্যের প্রষ্ফুটন
নেশামুক্ত সুরের ভুবন’।৫
সঙ্গীতশিল্পীদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যতে রৌশন ছড়ানোর জন্যে অনুশীলনের পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাস অটুট রাখার যথাযথ প্রয়োজন রয়েছে। তাদের উত্তমরূপ দেওয়ার প্রচেষ্টায় সঙ্গীত হয় জীবন্ত।
সঙ্গীতের নিজস্ব শরীর নেই। এমনকি হৃদয়ও নেই। অথচ সঙ্গীত মানুষের আত্মায় ঔজ্জ্বল্য দান করে। মনস্বী সঙ্গীতশিল্পীরা মনুষ্যলোকে খাদ্যাভ্যাস অটুট রেখে আবহমান বাঙালির সুস্থধারার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে লোকরঞ্জন এবং আলোকবর্তিকা হিসেবে অনন্তকাল এগিয়ে নিয়ে যাবে । এই প্রত্যাশা এবং দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে।
তথ্য ঋণ :
১. ডা. হারুন-অর-রশিদ, নাক,কান,গলা (ইএনটি) বিশেষজ্ঞ, তথ্যসূত্রের ক্রমিক নম্বর-১
২. ডা. মৃণাল কান্তি ঢালী, গীতিকবি ও চক্ষু বিশেষজ্ঞ, তথ্যসূত্রের ক্রমিক নম্বর-২
৩. ঐ, তথ্যসূত্রের ক্রমিক নম্বর-৩
৪. পূর্বোক্ত, ডা. হারুন-অর-রশিদ, তথ্যসূত্রের ক্রমিক নম্বর-৪
৫. পূর্বোক্ত, ডা. মৃণাল কান্তি ঢালী, তথ্যসূত্রের ক্রমিক নম্বর-৫
পীযূষ কুমার ভট্টাচার্য্য : লেখক ও নজরুল গবেষক, বাংলাদেশ।
খাদ্যাভাসে অটুট স্বরতন্ত্র -শিরোনামের ভেতরে যে বিশাল একটা প্রাপ্তি থাকবে তা বুঝতে পারিনি। লেখক ও নজরুল গবেষক পীযূষ দাদা আপনার
পরিশ্রম স্বার্থক কারণ এটা সঙ্গীত শিল্পীদের তো সাহায্য করবেই তৎসঙ্গে বাচিক শিল্পী এবং সাধারণ মানুষেরা যদি মেনে চলে তারাও ভীষণ উপকৃত হবে এবং সুস্থ থাকবে।
খুব সুন্দর তথ্যসমৃদ্ধ এবং মানসম্পন্ন একটি লেখা।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে দাদা।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য…
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। ভালো লাগলো দাদা।
খুব ভালো লেখা। সবার পড়া দরকার।
আপনার লেখা যতই পড়ি ততই ভবিষ্যতে পড়ার আকাঙ্খা সৃষ্টি করে। অপেক্ষায় রইলাম পরবর্তী লেখা থেকে বিভিন্ন তথ্য জানার জন্য।