আয়শা জাহান নূপুর’র কবিতা

অলংকরণ : মাসুক হেলাল
১.
মোহগন্ধা
হাওয়া খেয়ে বাঁচি, হাওয়ায় হাওয়ায় মিলিয়ে যাবো।যেতে যেতে থেমে যাবো মেহগনি পাতার ফাঁকে,যেখানে দোকান খুলেছে অদ্ভুত, পলাতক কিছু আলো।আমিও উদার জমিন—ঢেলে দিই মুঠো মুঠো, সোনার মতো ধানের দেহ।যদি হঠাৎ উড়ে আসে দৈবাৎ নরম রঙের শাড়ি!বোধকরি ঘুম থেকে জেগে গেছে দূরাগত চাঁদ,সরে গেছে নতুন বউয়ের বুকের আঁচল কিংবা যদি ভুল না হয়
—তবে এখনই তিরতিরে বয়ে যাবে সুগন্ধার জল।দিনের খোলস ছেড়ে উড়ে যাবে পাখি প্রেম!প্রেমের মতো যাতনা যে পায়, সে ই হয় আদিবাসী।সিন্দুকের গোপন সংবাদের মতো বয়ঃসন্ধি -দু’পায় বেয়ে নেমে আসে তৃষ্ণার্ত মাটির ঠোঁটে।বড় নিশ্চিন্তে আমিও ভুলে যাই কেয়ামত কত দূর!
২.
তোমার জন্য প্রাচীন ব্যথা
তোমার পৃথিবীতে বহুবার এসেছি আমি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ।
শুধু তোমাকে সবচেয়ে বিশুদ্ধ, প্রয়োজনীয় কথা বলবার জন্য।
একা পাইনি কোনো বার, দিনশেষে সময়ের অপূরণীয় ক্ষতি।
আচ্ছা, তুমি কি কখনো, কেবল তোমার থাকো না, কখনো?
বলে দাও, শুধু এই নিরলস শ্রম ব্যর্থ করে কী লাভ তোমার?
প্রতি জন্মের জন্যই তপস্যা করতে হয় তোমার জন্য আমার।
অথচ, খুব ভোরে স্নান শেষে ঈশ্বর বন্দনায় সময় কাটাও।
বছরের পর বছর ইউক্যালিপটাসের নিচে শান্ত সকালে,
সঙ্গিনীর সাথে কফিতে মশগুল, পাশে পড়ে থাকে প্রিয় বই।
ঝর্নার মতো হাসতে হাসতে এলিয়ে পড়েছো শুদ্ধ প্রাচীন বিছানায়।
একটু একটু করে আলো ফুটতেই ছুটে যাচ্ছো এ ঘর ও ঘর।
বহু চেষ্টা করে কখনও তোমাকে পাইনি একান্তে, আমার।
ব্যস্ত সড়কে, তীব্র দহনে ঘেমে নেয়ে এখানকার হয়ে ফিরেছ,
দেখেছি শেষ বেলায়ও হাতে অপ্রয়োজনীয় পার্থিব সরঞ্জাম।
আমার চোখের দৃষ্টির কাছে এডিসনের আলো বড় ক্ষীণ, ম্লান।
মনে আছে অবিকল পৃথিবীর সদ্যজাত প্রিয় লিখিত বর্ণমালা।
চাইলেই বলে দিতে পারি সভ্যতার কোনো গর্ভে জন্ম তোমার।
এই সব ইতিহাস পাঠ্য করে নিয়েছিলাম ব্যক্তিগত সিলেবাসে।
আজ বড্ড অসহায় লাগে নিজের প্রতিবিম্বের সামনে দাঁড়ালে।
ফসলের আয়োজন শেষে চাষির শূন্য হাতের মতো প্রতিক্ষা।
সব গাণিতিক হিসেবের মিল হয়না জেনেও বাকি পথ কেবল,
দীর্ঘ হচ্ছে, তবুও কেউ বারবার জন্মাতে চায় ভরা আকালে।
আমি না হয় পিথাগোরাসের গুরত্বপূর্ণ সম্পাদ্যর মতো আবার আসব,
দেখব তুমি পাশ দিয়ে হেঁটে যাবে কিছু না দেখে।
৩.
একটি পৃথিবীর কবিতা
সেই সব পাতা ঝরা দিনগুলো স্মৃতির এ্যালবামে জমে উঠে।
আকাশের জমিনে ফুটে থাকা অসংখ্য শিমুল ছিল প্রেরণায়।
আমরা প্রত্যেকেই সে বেলায় ফুল নয় আগুনই দেখতাম।
সে দৃশ্য আমাদের চোখে দেখা উজ্জ্বলতর মুহূর্ত হয়ে থাকে।
আঁধারের উঠোনে সকলি এক একটা পারিজাত,
দেবতার বাগানে চুরি হওয়া প্রয়োজনীয় প্রেম।
জীবনের গভীরে আরও এক দর্শনের পাঠ।
জীবনের গভীরে আরও এক মিথ্যার আবাদ আমরা পরিহাস করতাম, নিজেকে ভালোবেসে।
এই ক্ষয়ে যাওয়া পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই স্বীকার করে, একটি ভুল চিঠি তার ঠিকানায় এসেছে।
এই বিস্তীর্ণ আলোতেও ধরা পরে নিজেদের প্রগাঢ় অন্ধকার, যা সম্পর্কের খুব কাছে বাস করে।
তবুও আমরা মেখেছি বিশ্বাসের মলম জরায়ূতে।
বিনীত পাঠ নিয়েছি বৈশ্বিক পাঠশালায়।
মূল্যবোধ বেড়ে উঠুক ফলবতী বৃক্ষের মতোন।
মানবতা বাচুক বোধ আর ভালোবাসার কবিতায়।
৪.
সংলাপ নেই যে কথোপকথনে
উইপিং দেবদারুর বিষাদে নত মুখ।
শেষবার তার সাথে দেখা হয় একটা ঝুপড়িতে।
গুমোট, হাসফাস করা স্বল্প আলো ছিল।
নড়বড়ে একটা টুল টেনে মুখোমুখি আমরা।
সেদিন ঘরের একটিমাত্র জানালা খোলা ছিল,
সেখান থেকে দেখেছিলাম উপিং দেবদারুর বিষাদনামা।
ততদিনে আমার বদল হয়।
নিয়ম করে সিঁদুর ছুঁই।
পূঁজো পার্বনে আসা হয় এদিকটায়।
বিরহের বই বাক্স বন্দি করে রাখি।
মাঝেমধ্যে আঁচল দিয়ে ধুলো ঝাঁড়ি।
এমন ভাবে ছুঁয়ে দেখি যেন জেগে না উঠে!
সেদিনের মুখোমুখি বৈঠকে কোন ইস্তেহার নেই।
অভিযোগের কাঁদা ছোড়া ব্যাকরণ নেই।
কোনো পরিপূর্ণ বাক্য নেই এ আয়োজনের।
তবে আমাদের বৈঠক ব্যর্থ হয়নি সেদিন।
মনে হচ্ছিল ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিচ্ছে সব—
ঝলমলে দিনের গল্প, ঠোঙ্গা ভর্তি বাদাম উবে যাচ্ছে ,
শিশুর হাতে থাকা হাওয়া মিঠাইয়ের মতোন।
তারপর, আর কোনোদিন আমাদের দেখা হয়নি।
শেষবার তার সাথে দেখা হয় একটা ঝুপড়িতে,
যার ছিল একটিমাত্র খোলা জানালা,
জানালার পাশে উইপিং দেবদারু।
আমি সেদিকটায় তাকিয়ে তখন মুখোমুখি।
৫.
আমার কি অসুখ, বলো ?
এদিকে চেয়ে দ্যাখো, কিছু ধুম্রজাল।
পুইঁয়ের লতার মতো ভরে গেছে চাল।
আধাঁরের সার্সি বেয়ে নেমে আসে কুয়াশার ক্ষেতে।
আমিও ধবল তুলো, উড়ে বাঁচি আকাশ মুখে নিয়ে।
আমার কি অসুখ, বলো?
টুপটাপ দিঘির জলে হয় শিশিরের ক্ষয়।
পদ্মের পাতাখানি শরীর ছড়ায়,
বড় বেশি লোভ তার গন্ধ যদি পায়।
আমিও পেতে চাই ততটুকু ঘ্রান, যতটুকুই ভেসে ওঠে সুপেয় পরান।
আমার কি অসুখ, বলো?
এরপর চেয়ে দ্যাখো মাটিতে,
চোখ রাখো গভীরে, যেথায় কর্মফল।
অন্তরে বিপ্লব হলে লাভা বের হয়,
ভিতরের ঘরগুলি জ্বলে থাকে,
বারোমাসি প্রেম বুকে তার।
আমিও পেতে চাই অভিমানী ঝড়,
বজ্রের চিৎকারের পার ভাঙ্গুক এপার ওপার।
আমার কি অসুখ, বলো?
এই দিকে চোখ তোলো,
দ্যাখো আকাশের দেয়ালে ঝুলে থাকা জোছনার ফুল।
মাঝেমাঝে খসে পরে আলোময় পথ থেকে,
দিক ভুলে ছুটে চলে সড়ক বেপুথ।
আমিও পেতে চাই আলোকিত রাত,
তোলপার ঢেউ এসে ছুঁয়ে যাক বুক।
আমার কি অসুখ, বলো?
তারচেয়ে এই ভালো—
কেউ এসে বুঝে নিক, দেখে দিক মুখ,
কানে কানে বলে যাক, আমার কি অসুখ!