ভগৎ সিং একজন বীর নায়ক

ভগৎ সিং, পাঞ্জাব তথা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক বীর নায়ক। তিনি জন্মগ্রহণ করেন পাঞ্জাবের লায়ালপুর জেলায় খাতকর কালান গ্রামে। পিতা সর্দার কিসান সিংহ সান্ধু, মাতা বিদ্যাবতী। জীবনকাল মাত্র ২৩ বছর। গান্ধীজীর বিপরীতে ছিল তার আন্দোলনের রূপরেখা, বিপ্লরচেতনা। তথাপি ‘Bhagat Singh name was widely known all over India and was as popular as Gandhigi’.
ভগৎ সিং এর বিপ্লবী জীবনের সূচনা হয় চন্দ্রশেখর আজাদের Hindusthan Republican Parts (HRP)-র সদস্যপদ গ্রহণ করে। ১৯২৫ সালে তিনি নিজে ‘নওজওয়ান ভারত সভা’ নামে এক যুব সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৬ সালে HRP তাঁর নেতৃত্বে ‘Hindusthan Socialist Republic Parts (HRSA) নামে নতুন রূপ পায়, যার উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষকে এক সমাজতান্ত্রিক, প্রজাতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
১৯২৮ সালে ১৭ নভেম্বর ভগৎ সিং ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার John Sauders কে গুলি করে হত্যা করেন। এ ছিল Sauders দ্বারা লাহোরে লালা লাজপত রায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ। বিচারর ১৯৩০ সালে ৭ অক্টোবর তাঁর ফাঁসির আদেশ হয়। জেলে বন্দী থাকাকালীন ভারতীয় বন্দীদের উপর অত্যাচার ও বৈষম্যের প্রতিবাদে সহবন্দীদের নিয়ে আমরণ অনশন শুরু করেন। ১৯৩১ সালে ২৩ মার্চ নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই তার ফাঁসি হয়। মৃতদেহ অজ্ঞাতাসারে দাহ করা হয়। আজীবন লেনিনের আদর্শে অনুপ্রাণিত তিনি, শোনা যায় ফাঁসির আগে পরছিলেন ‘লেনিনের জীবনী’। ডাক আসায় তিনি সংশ্লিষ্ট অফিসার কে বললেন, ‘দাঁড়ান একজন বিপ্লবীর সঙ্গে আরেকজন বিপ্লবীর সাক্ষাৎকার চলছে’। এরপরই দৃপ্ত ভঙ্গিমায় ফাঁসির মঞ্চে অগ্রসর হন, মৃত্যুকে বরণ করেন।
তিনি ঈশ্বরবাদী নন, তিনি মানব পূজারী। তাঁর আদর্শের ভরকেন্দ্র মানবতাবাদ। তাঁর স্বপ্ন ছিল শোষনহীন, মুক্ত ভারতবর্ষ। তাঁর লেখা প্রবন্ধ Why I am an atteist. তাঁর নাস্তিকতার অহংকার, যা ঈশ্বর ও ধর্মকে দাঁড় করায় প্রশ্নের মুখে। তাঁর জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করি এক উদ্ধৃতি দিয়ে—
ধর্ম যদি উপহার দেয় শিশু মৃত্যুর শোক,
প্রতিটি মায়ের গর্ভে নাস্তিকের জন্ম হোক।
রাষ্ট্র যদি উপড়ে নেয় মানবতার চোখ,
প্রতিটি মায়ের গর্ভে বিপ্লবের জন্ম হোক।
দেশপ্রেমিক এক শিখ পরিবারে ১৯০৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ভগৎ সিং জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবারের সদস্যরা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। পড়াশোনা করেন আর্য সমাজি বিদ্যালয় দয়ানন্দ অ্যাংলো বৈদিক স্কুলে। বয়স যখন ১২ বছর সেই সময় সংঘটিত হয় জালিয়ানওলাবাগ হত্যাকাণ্ড। স্কুল থেকে চলে যান জালিয়ানওলাবাগ, ফেরেন রাতে জালিয়ানওয়ালাবাগের শহীদ রক্তমাখা মাঠ হতে। ইতিহাস এবং বিপ্লবীদের জীবনে তাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করত। কৈশোরেই ভগৎ ইউরোপীয় বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাস এবং কমিউনিজমের প্রতি আকৃষ্ট হন।যোগ দেন স্বাধীনতা বিপ্লবী সংগঠনে। মাত্র ১৩ বছর বয়স। যোগ দেন গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনে। প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন ব্রিটিশ রাজশক্তির। পুড়িয়ে ফেলেন স্কুল, বই ও বিলেতি স্কুল ইউনিফর্ম। ১৯২২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি উত্তরপ্রদেশের গোরখপুর জেলার চৌরিচেরা গ্রামে ব্রিটিশ পুলিশ কৃষকদের শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করতে গুলি চালায়।মারা যান কয়েকজন কৃষক। বিক্ষুব্ধ জনতা ক্ষুদ্ধ হয়ে থানা ঘেরাও করে,আগুন জ্বালিয়ে দেয়। ২২ জন পুলিশ থানার মধ্যে পুড়ে মারা যায়। গান্ধীজী এই ঘটনায় অসহযোগ আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ান। ভগৎ সিং হতাশ হন এবং সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের পক্ষে যুব বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দেন। ভগৎ সিং পাঞ্জাবে অনুষ্ঠিত প্রবন্ধ রচনা প্রতিযোগিতায় জয় লাভ করেন। কবিতা এবং সাহিত্য পাঠে অংশগ্রহণ করেন। কবি আল্লামা ইকবাল ছিলেন তার অন্যতম প্রিয় একজন কবি।
ভগৎ সিং কলেজে যোগদান করেন, যুক্ত হন ‘নওজওয়ান ভারত সভা’য়। এরপর গড়ে তোলেন HRSA। বিপ্লবী সহকর্মী যুবকদের বিপ্লবের নেতৃত্ব দেন।
১৯২৮ সালের ৩০ অক্টোবর,লাহোরে ঘটে ব্রিটিশদের নারকীয় অত্যাচারের আরেক ঘটনা। লালা লাজপত রায়ের নেতৃত্বে চলা এক নীরব অহিংস পদযাত্রায় পুলিশ লাঠিচার্জ করে। লাজপত রায় গুরুতর আহত হন, পরে মৃত্যুমুখে পতিত হন। ভগৎ সিং ছিলেন ওই পদযাত্রায়। প্রতিজ্ঞা নেন প্রতিরোধের। রাজগুরু, সুখদেব, জয় গোপালের সঙ্গে ভগৎ সিং লাহোর ঘটনার নেতৃত্বদান করে। পুলিশ প্রধান স্কটকে হত্যার পরিকল্পনা করেন, কিন্তু ঘটনাক্রমে ভুলবশতঃ তারা স্কটকে চিহ্নিত করতে পারেন না। পরবর্তে Saudersকে তারা Scott মনে করেন। ভগৎ সিং এর গুলিতে স্কট মারা যায়। ভগৎ সিং আত্মগোপন করেন। চলে আসেন কলকাতায়। আশ্রয় নেন বিপ্লবী যতীন দাসের কাছে এবং সতর্কভাবে বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন।
১৯২৯ সালের ৮ এপ্রিল ব্রিটিশ সরকার Central Legislatire Assemblyতে বিপ্লবীদের দমন করার জন্য পুলিশকে অধিক ক্ষমতা প্রদান করার উদ্দেশ্যে ভারত প্রতিরক্ষা আইন পাস করার প্রস্ততি নেয়। এই আইনকে রোধ করার জন্য ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত অ্যাসেম্বলির সভায় প্রতিবাদ ও বোমা নিক্ষেপ করেন। পলায়ন নয়, ইশতেহার বিলি করতে থাকেন হাজার। পরিণামে ধরা পরেন। বিচারে ১৯৩০ সালে ভগৎ সিং এর ফাঁসির আদেশ হয়। যদিও প্রথমে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। ভারতীয় বন্দীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি জেলে ৬৪ দিন অনশন করেন। জেলে ফাঁসির অপেক্ষায় থাকা ভগৎ সিং লিখলেন এক অসামান্য প্রবন্ধ ‘Why I am an atheist’ যা তার ফাঁসির কয়েক মাস পরে প্রকাশিত হয় ‘The People’ (Lahore, 27th Sept 1931) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধে তিনি তার নাস্তিকতা সদর্পে ঘোষণা করেছেন। প্রশ্ন তুলেছেন ধর্ম ও ঈশ্বরের দিকে। ১৯৩১ সালের ২৩ শে মার্চ ফাঁসির মঞ্চকে এক পবিত্র মঞ্চে পরিণত করে হাসিমুখে মৃত্যুবরণ করলেন। প্রমাণ করলেন তাঁর মাতৃভক্তি, স্বদেশপ্রীতি। মৃত্যুকে জয় করলেন। তার জীবন ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিন্তাভাবনাহীন’ এর নৈসর্গিক প্রকাশ স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন চোখে মেখে অমরতার পথে যাত্রা।