মানুষ প্রকৃতি ঈশ্বর ভাবনার প্রতিভূ সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

ছাত্রাবস্থা থেকেই সাহিত্য পড়ার প্রতি ছিল প্রচণ্ড নেশা, ভালোলাগা। সিলেবাসের পড়াশোনার বাইরে অবসর যাপনের প্রধান সঙ্গী ছিল বই পড়া। সেখানে অবশ্যই ছোট গল্প এবং পরবর্তীতে তরুণ বয়সে প্রাধান্য পেয়েছে উপন্যাস। সমকালীন জীবনযাত্রা, চিন্তাভাবনা, ধ্যান ধারণা, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, সমস্ত কিছুকেই সুন্দর সাবলীল অনুরূপভাবে ছবির মত প্রতিবিম্বিত হয়ে উঠতো সাহিত্যের পাতায় পাতায়। বাঁধভাঙা উচ্ছ্বসিত মনন যেন একাত্ম হয়ে উঠতো সেই সমস্ত সাহিত্যিকের সৃষ্ট চরিত্রের অবয়বে। সাহিত্য যেন প্রকৃতার্থে জীবনের সুখ দুখ, ভালোলাগা জীবনচরিত দৈনন্দিন অনুভূতির সুচারু বহিঃপ্রকাশ এখানেই সাহিত্য কালোত্তীর্ণ। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই উতরাই, সংগ্রাম লড়াইয়ের দীর্ঘ পথে সাহিত্য যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এরকমই এক ভালো লাগা, ভালোবাসার, মননশীলতার কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
সত্যি কথা বলতে সাহিত্যনুরাগী মনস্কতায় বিভূতিভূষণের মননশীল, মরমী, জৈবনিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সাহিত্য সম্ভার অসাধারণ অনবদ্য। তার লেখনীতে খুঁজে পেয়েছি জীবনকে নতুন ভাবে দেখার, খোঁজার, অনুভবের, চেতনার, ভালোবাসার। সর্বোপরি চিরাচরিত আটপৌরে জীবনযাত্রা থেকে বেঁচে থাকার এক নতুন অভিমুখ। এখানে জীবন প্রাণবন্ত, সৃষ্টিশীল, বহুমাত্রিক। সাহিত্য দিশা দেখায় প্রতিটা জীবনের বাসনা স্বপ্নগুলোকে।এভাবেই বাংলা সাহিত্যের বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় অসাধারণ সৃষ্টিশীলতায় সাহিত্যের জগতে বিরাজিত।
এবারে আলোকপাত করা যাক বিভূতিভূষণের সাহিত্যিক জীবনের বিবিধতায়।তৎকালীন সময়টা ছিল বিশ শতকের তিনের দশক। সেই সময় বাংলা সাহিত্যের মধ্যগগনে চরমভাবে বিরাজ করছেন লেখক কবি রবীন্দ্রনাথ ও অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র। তাঁদের সম্মিলিত সৃষ্টি ধারায় বাঙালি পাঠককুল মন্ত্রমুগ্ধ। তার সঙ্গে সঙ্গে গতানুগতিক ভাবনার বিপ্রতীপে এক পাল্টা হাওয়ার প্রবাহ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে হাজির হলেন কল্লোল গোষ্ঠীর লেখককূল। পাঠক সমাজ তাতে চমকিত, বিস্মিত।আর ঠিক এমনই সময়ে এই দুই ভাবনা —রীতির বাইরে গিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব ভঙ্গিতে মানুষ, প্রকৃতি আর ঈশ্বর ভাবনার সম্মিলিত রূপকে সহজ সরল ভাবে তুলে ধরে সাহিত্যাকাশে ধ্রুবতারা হিসেবে আবির্ভূত হলেন অপ্রতিরোধ্য কথা সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা সাহিত্যে উন্মোচিত হলো এক নতুন অধ্যায়। সাহিত্যের ভাষায়, ভাবনায় চিন্তনে এল এক নতুন পরিবর্তন। বিভূতিভূষণ লেখনী ক্ষমতার জাদুতে পাঠক কে নিয়ে গেলেন অন্য ভাবধারার জগতে। অতি দ্রুত তিনি হয়ে উঠলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয়, বিচিত্র অভিজ্ঞতা লব্ধ, মননশীল, বহু চর্চিত ও পঠিত সাহিত্যিক।সভ্যতা ও সংস্কৃতির এক অস্থির, সংকটময় সময়ে অবস্থান করেও জগৎ ও জীবনের আনন্দময় রূপকে অনুভব করেছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘জীবনকে যারা দুঃখময় বলেছে, তারা জীবনের কিছুই জানে না, জগৎটাকে দুঃখময় মনে করা নাস্তিকতা। জগৎ হল সেই আনন্দময়ের বিলাস বিভূতি” । উপন্যাস ও ছোটগল্প রচনাকে স্বক্ষেত্র-রূপে নির্বাচন করলেও তার স্থানিক পটভূমি, সামাজিক ব্যক্তি-মানুষ এবং দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্বতন্ত্র এবং প্রত্যেকেই স্বক্ষেত্রে ছিলেন স্বরাট। বিভূতিভূষণ ব্যক্তিজীবনে প্রধানতঃ শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও মাঝে মাঝে তাকে কর্মান্তর গ্রহণ করে বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এবং এইভাবেই তাকে এক গােরক্ষিণী সভার প্রচারক, গৃহশিক্ষক, প্রাইভেট সেক্রেটারী, নায়েব, তহশিলদার প্রভৃতি বিচিত্র কর্মজীবনের সঙ্গে যুক্ত হতে হয়েছিল। তবে এই বিচিত্র জীবনচর্যা তার বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা আহরণের সহায়ক হয়েছিল। কর্ম-উপলক্ষে নিয়ত বাসস্থান পরিবর্তনের কারণেও বিভূতিভূষণ যেমন বাঙলার পল্লীজীবন ও নাগরিক জীবনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তেমনি ভাগলপুর, ঘাটশিলা, বিহার প্রভৃতি অঞ্চলে বাসকালে পাহাড় ও অরণ্যের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসবারও সুযােগ পেয়েছিলেন। বস্তুতঃ এ সমস্তই তার মনোজীবন-গঠনে এবং সাহিত্য রচনায় বিরাট ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। এক কথায় সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় জীবন ছিল বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ। সেখানে শুধুই মিশে আছে সাহিত্যের ঘটনা স্থান-কাল চরিত্র।
পাঠক সমাজ তাতে চমকিত, বিস্মিত।আর ঠিক এমনই সময়ে এই দুই ভাবনা —রীতির বাইরে গিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব ভঙ্গিতে মানুষ, প্রকৃতি আর ঈশ্বর ভাবনার সম্মিলিত রূপকে সহজ সরল ভাবে তুলে ধরে সাহিত্যাকাশে ধ্রুবতারা হিসেবে আবির্ভূত হলেন অপ্রতিরোধ্য কথা সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা সাহিত্যে উন্মোচিত হলো এক নতুন অধ্যায়। সাহিত্যের ভাষায়, ভাবনায় চিন্তনে এল এক নতুন পরিবর্তন। বিভূতিভূষণ লেখনী ক্ষমতার জাদুতে পাঠক কে নিয়ে গেলেন অন্য ভাবধারার জগতে। অতি দ্রুত তিনি হয়ে উঠলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয়, বিচিত্র অভিজ্ঞতা লব্ধ, মননশীল, বহু চর্চিত ও পঠিত সাহিত্যিক।
বিভূতিভূষণ তার সমকালীন লেখকদের তুলনায় সাহিত্যজগতে একটু ভিন্ন পথের পথিক ছিলেন। তাঁর উপন্যাসগুলিতে সমাজ-বাস্তবতা বা জীবন-সমস্যা তত প্রখরভাবে ফুটে ওঠেনি; পক্ষান্তরে তিনি অনেকটা কবি-দার্শনিক-সুলভ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই জগৎ ও জীবনকে দেখতে চেষ্টা করেছেন। যে তিনটি প্রধান উপাদানকে অবলম্বন করে বিভূতিভূষণের সাহিত্যজগৎ সৃষ্টি হয়েছে, তাতে আছে প্রকৃতি চেতনা, অধ্যাত্মচেতনা এবং বর্তমান বিশ্বচেতনার স্বরূপ-উপলব্ধি ও অতীতের স্মৃতিচারণ। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘‘বিভূতিভূষণ আর সমস্ত সার্থক-কর্মা দিব্যদৃষ্টি লেখকের মত এই দুইটি প্রধান বিষয় বা বস্তু নিয়েই যা কিছু বলবার তা বলে গিয়েছেন।’ সেই দু’টি প্রধান বিষয় হল প্রকৃতি আর মানুষ। প্রকৃতির কথা কিছু হল। মানুষ নিয়ে আরও ভয়ের কিছু বাস্তব এঁকেছিলেন বিভূতিভূষণ। বাংলা সাহিত্য কি অন্য আঙ্গিকে অন্য ধারায় প্রবাহিত করতে চেয়ে ছিলেন তিনি।১৯২৯ খ্রীঃ ‘পথের পাঁচালী’ রচনার মধ্য দিয়েই বিভূতিভূষণের সাহিত্য-সাধনার ক্ষেত্রে যাত্রা শুরু। অবশ্য তার অনেক পূর্বেই ‘প্রবাসী’ সাময়িকপত্রে ‘উপেক্ষিতা’ নামক একটি ছোটগল্পেই তার হাতেখড়ি হয়েছিল। তবে পূর্ণ সিদ্ধি আয়ত্ত হয় ‘পথের পাঁচালীতে’ই।
এর পরে তিনি যথাক্রমে নিম্নোক্ত উপন্যাসগুলি রচনা করেন ও ‘অপরাজিত”চাদের পাহাড়’, ‘আরণ্যক’, ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’, ‘দেবযান’ ‘কেদার রাজা’ ‘ইছামতী’, ‘অশনি সংকেত’ প্রভৃতি। প্রত্যেকটি উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের মণিমুক্তো । উপন্যাসকে তিনি জীবন দর্শন ও বাস্তবতার নিরিখে এক স্বতন্ত্র পরিচয় দিয়েছিলেন। যেখানে পাঠক খুঁজে পেয়েছিল সাহিত্যের এক অনন্য অনালোচিত ভালোলাগা রসবোধ ।বিভূতিভূষণ ছােটগল্প রচনার মধ্য দিয়েই প্রথমে হাত পাকিয়েছিলেন এবং নিঃসন্দেহেই পরবর্তীকালে তাতে সিদ্ধিও অর্জন করেছেন। তিনি দুই শতাধিক ছোটগল্প রচনা করেন এবং তা উনিশটি গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়। তার প্রধান গল্পগ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে ‘মেঘমল্লার’ ‘মৌরিফুল’, ‘যাত্রাবদল’ ‘তালনবর্মী’ ‘কুশলপাহাড়ী’ প্রভৃতি। এগুলি ছাড়াও বিভূতিভূষণের রচিত বিভিন্ন উপন্যাস ও ছোটগল্পের মধ্যে রয়েছে ‘দৃষ্টিপ্রদীপ’, ‘কিন্নরদল’ ‘অনুবর্তন’ ‘মুখাশে ও মুখশ্রী’ ‘অভিযাত্রিক’, ‘বিপিনের সংসার’, ‘তৃণান্ধুর’, ‘উর্মিমুখর’ প্রভৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সমস্ত ব্যতীতও বিভূতিভূষণ শিশুসাহিত্য, দিনলিপি প্রভৃতি রচনায় বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যকে বিভূতিভূষণ তার সৃষ্টি সম্ভারে সমৃদ্ধ পরিপূর্ণ করেছিলেন। সাহিত্য যে প্রকৃত অর্থে মানুষের জীবনকে সুচারু স্থিতিশীল সুষম ও মননশীল ভাবে পরিস্ফুট করতে পারে, সাধারণ মানুষ স্থান-কাল চরিত্রের আবর্তনে বাঙ্ময় হয়ে উঠতে পারে তা স্পষ্টভাবে বিভূতিভূষণ নিজস্ব সৃষ্টিশীলতায় প্রকাশ করেছেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিভীষণের সৃষ্টিসম্ভার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত। তার কালজয়ী সাহিত্য বাঙালি পাঠককে সর্বদা আকৃষ্ট, মুগ্ধ, উদ্বেলিত করে তুলে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিভূতিভূষণের নাম চিরস্মরণীয়। প্রিয় সাহিত্যিকের প্রতি রইল প্রাণভরা শ্রদ্ধা ভক্তি ভালোবাসা।