প্রখ্যাত কথাশিল্পী শহীদুল জহিরের ৬৮তম জন্মবার্ষিকী আজ

শহীদুল জহির [১ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩—২৩ মার্চ ২০০৮], প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম খ্যাতিমান কথাশিল্পী শহীদুল জহির। সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণশীল হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠিত। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে জাদুবাস্তবতার স্বাতন্ত্র্য চর্চার জন্য তিনি পরিচিত। নিত্য নতুন ভাষাবিন্যাস এবং রীতি-ব্যবহারে গল্প বলার কৌশলের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে তিনি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করেছেন। বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি যোগ করেছেন স্বতন্ত্র রীতি পদ্ধতি, যা ‘শহীদুল জহিরীয়’; ধারা নামে পরিচিত। এই প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিকের আজ ৬৮তম জন্মবার্ষিকী।
১৯৫৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পুরান ঢাকার নারিন্দার ৩৬ ভূতের গলিতে (ভজহরি সাহা স্ট্রিট) তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা তাঁর নাম ছিল মোহাম্মদ শহীদুল হক। বাবা এ কে নুরুল হক ও মা জাহানারা খাতুন। বাবা ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। তাঁরা ছিলেন চার ভাই ও চার বোন। পৈতৃক নিবাস ছিল সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের হাশিল গ্রামে।
১৯৫৭ সাল পর্যন্ত জহির পিতার কর্মস্থলে কারণে কুমিল্লার চাঁদপুরে কাটান। সে বছরই তিনি পুরান ঢাকার নারিন্দার ৩৬ ভজহরি সাহা স্ট্রিটে ফিরে আসেন।

শহীদুল জহির স্কুল জীবন শুরু করেন ঢাকার ৩৬ র্যাঙ্কিন স্ট্রিটের সিলভারডেল কেজি স্কুলে। সেখানে তিনি ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত পড়েছিলেন। পরবর্তীতে ঢাকার নারিন্দায় সেন্ট যোসেফ টেকনিক্যাল বিদ্যালয়ে এক বছর পড়ে। ১৯৬৩ সাল তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এরপর ঢাকার বাইরে ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত পড়েছেন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া হাইস্কুলে। পরবর্তী বছর, অষ্টম শ্রেণিতে জহির চট্টগ্রামে চলে আসেন। সেখানে তিনি সাতকানিয়া আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। একই বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ সালে মানবিক বিভগ থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন সম্পন্ন করেন। এরপর উচ্চমাধ্যমিক পড়ার জন্য জহির পুনরায় ঢাকায় ফিরে আসেন। ১৯৭২ সালে ঢাকা কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে তিনি এইচএসসি পাশ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকবর্ষে ভর্তি হন। তিনি ১৯৭৬ সালে স্নাতক এবং ১৯৭৭ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন তিনি।

পরবর্তীতে জহির দেশের বাইরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি গ্রহণের পূর্বে ১৯৮৮ থেকে ১৯৯০ সালে তিনি আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকা থেকে ফরাসি ভাষা বিষয়ে ডিপ্লোমা করেছিলেন। ১৯৯১ সালের আগস্টে তিনি মার্কিন যুক্টরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন, ডি.সি.র আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়ন করতে যান। সেখানে তিনি ১৯৯২ সালের জুনে নন-ডিগ্রি সার্টিফিকেট ইন প্ল্যানিং অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে ডিগ্রি নেন। ২০০১ সালের জুনে তিনি ইউনিভার্সি অব বারমিংহাম থেকে উন্নয়ন প্রকল্প বিষয়ে ডিগ্রি নিয়েছিলেন।
শৈশব থেকেই পারিবারিক পরিবেশ শহীদুলের সাহিত্য মানস গঠনে বিশেষ প্রভাব ফেলে। বাবা লেখালেখি করতেন। চাচাতো ভাই সমুদ্র গুপ্ত সুপরিচিত কবি। ছাত্রজীবন থেকেই শহীদুলের সাহিত্যচর্চায় হাতেখড়ি। কর্মজীবনে আমলাতন্ত্রের সিঁড়ি বেয়ে অনেক ওপরে উঠলেও নিতান্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন। ব্যক্তিজীবনে ছিলেন অন্তর্মুখী, নিভৃতচারী। সাহিত্যিক হিসেবে যেমন, দাপ্তরিক কাজেও তেমন নিষ্ঠাবান ছিলেন। তাঁর রচনায় জীবন বাস্তবতার স্পন্দন গভীরভাবে অনুভূত হয়। সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণশীলতা ও অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করে নিজের রচনাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলেন তিনি। তাঁর লেখায় বারবার করে নিজেকে ভাঙার, নতুন করে উপস্থাপনের চেষ্টা রয়েছে। ফেলে আসা জনপদ অনুপুঙ্খভাবে এবং অবলীলায় ধরা দিয়েছে তাঁর রচনায়। শহীদুল জহিরের উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে: ‘ডলু নদীর হাওয়া’, ‘মুখের দিকে দেখি’, ‘পারাপার’, ‘চতুর্থ মাত্রা’, ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য’, ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ প্রভৃতি। তাঁর গল্পের কাহিনি সাদামাটা হলেও অসাধারণ বুনোটে, ভাষার মাধুর্যে আর অনুপম উপস্থাপনায় নতুনত্বের ছোঁয়ায় উদ্ভাসিত হয়। বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁর সৃষ্টিসম্ভার বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। ২০০৮ সালের ২৩ মার্চ প্রয়াত হন শিল্পী শহীদুল জহির।
তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, দৈনিক আজাদী