প্রথাগত ছক ভাঙ্গা কবি ছিলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

বাংলার এক প্রবাদ প্রতিম কবি শতবর্ষ পার করলেন আজ। সেই কবির নাম বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কোনোদিন কোনো বড় প্রতিষ্ঠান, প্রকাশনীর প্রচার না পেয়েও শুধুমাত্র সহজাত কবিত্বের জারণে, বাস্তবায়নে পুরোদস্তুর মানবিক চিন্তা চেতনার দর্শনে পাঠকদের অফুরন্ত ভালোবাসা, শ্রমজীবী জীবন, অনবদ্য কবিতার সৃষ্টিশীলতায় এখনও তিনি বেঁচে আছেন বাংলা কবিতা জগতে।দুঃসময়ের কবি যেন আরও প্রাসঙ্গিক চিরায়ত এই বাংলা ভাষায়। গতবছর ২ সেপ্টেম্বর শতবর্ষে পা রেখেছিলেন এই আটপৌরে সাধারণ যাপিত জীবনের কবি। আজ তাঁর জন্মশতবর্ষের পূর্তিতে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে কবি সাহিত্যিক লেখকদের মধ্যে আসছে শুভেচ্ছা শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ভক্তি ও সম্মাননা। অথচ জীবদ্দশাতে এই স্রোতের বিপরীতে হাঁটা কবি প্রতিটি পদক্ষেপে পেয়েছেন নিদারুণ দগ্ধতা যন্ত্রনা। কিন্তু সাধারণ মানুষের লড়াই, অধিকার রক্ষার্থে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে, রাষ্ট্রশক্তির চোখে চোখ রেখে কথা বলতে, ন্যায্য দাবি আদায় করতে কখনো পিছপা হননি।সব সময় সজাগ থেকেছে শাণিত কলম।
বর্তমান করোনাকালে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কবিতা যেন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক তাৎপর্যমণ্ডিত এবং প্রতি মুহূর্তে আমাদের বিপদ থেকে উদ্ধারের পরিত্রান দেখাচ্ছে।
রাজা আসে যায় রাজা বদলায়/নীল জামা গায় লাল জামা গায় ….দিন বদলায় না’ বা ‘মাটি তো আগুনের মতো হবেই/ যদি তুমি ফসল ফলাতে না জান/যদি তুমি বৃষ্টি আনার মন্ত্র ভুলে যাও/ তোমার স্বদেশ তাহলে মরুভূমি’র মতো অমোঘ উচ্চারণে আজও প্রবল ভাবেই পাঠক সমাজে বেঁচে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়মানবতাবাদী সাম্যবাদী আধুনিক কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিশ শতকের চল্লিশের দশকের উল্লেখযোগ্য কবি। তাঁর কবিতার কেন্দ্রে আছে মানুষ ও স্বদেশ।তিনি সমকালীন জীবনের প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়কে উপলব্ধি করে, নগর সভ্যতার মূল্যবোধের অবক্ষয় লক্ষ করে মানুষ ও স্বদেশকে রক্ষার ইচ্ছায় কলম ধরেছিলেন।
প্রথম জীবনে যাঁদের কাছ থেকে কবিতা লেখার উৎসাহ পেয়েছিলেন, তাঁরা হলেন বিমলচন্দ্র ঘোষ এবং অরুণ মিত্র। কলেজে শিক্ষক ছিলেন বুদ্ধদেব বসু ও বিষ্ণু দে। সুভাষচন্দ্র বসু তখন তাঁর জীবনের প্রেরণা। ঋত্বিক ঘটকের মতোই দেশভাগ তাঁকে আলোড়িত করেছিল।
আক্ষেপ করেছিলেন, ‘‘আমার জন্মভূমিকে এখন আমি স্বদেশ বলতে পারি না।’’ চল্লিশের দশকে অনেক কবি-লেখকের সঙ্গেই তাঁর ঘনিষ্ঠতা। ছিলেন রাম বসু, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্তের মতো কবি, আবার অমিয়ভূষণ মজুমদারের মতো গদ্যকার, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতো গায়ক। বলতেন, ‘‘এদের সবাইকে নিয়ে আমার যে নিজস্ব পৃথিবী তার পায়ের নীচে কিছু শক্ত মাটি রয়ে গেছে, সেখানেই আমার অথবা আমাদের জোর।’
আক্ষেপ করেছিলেন, ‘‘আমার জন্মভূমিকে এখন আমি স্বদেশ বলতে পারি না।’’ চল্লিশের দশকে অনেক কবি-লেখকের সঙ্গেই তাঁর ঘনিষ্ঠতা। ছিলেন রাম বসু, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্তের মতো কবি, আবার অমিয়ভূষণ মজুমদারের মতো গদ্যকার, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতো গায়ক। বলতেন, ‘‘এদের সবাইকে নিয়ে আমার যে নিজস্ব পৃথিবী তার পায়ের নীচে কিছু শক্ত মাটি রয়ে গেছে, সেখানেই আমার অথবা আমাদের জোর।’
বন্ধু নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অনুরোধে ‘দেশ-এ লিখেছেন।
সমাজকে সাম্যবাদী দৃষ্টিতে দেখেছেন কবি। সেজন্য তার কবিতায় শোষিত, পীড়িত মানুষের দুর্গতির জন্য ক্ষোভ প্রকাশিত হয়েছে—কবি সুকান্তের মতো।রবীন্দ্রনাথ যেমন ‘ওরা কাজ করে কবিতায় শ্রমজীবী মানুষের বন্দনা করেছিলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও তাঁর কবিতায় দেশের শ্রমশক্তির জয় ঘোষণা করেছেন।তিনি সমকালীন জীবনে রাষ্ট্রীয় ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
তিনি মনে করতেন, রাষ্ট্র শ্রেণি শাসণযন্ত্র সেখানে বহু মানুষ অন্নহীন, বস্ত্রহীন ও আশ্রয়হীন হবে।এমনকি বাংলার খাদ্য আন্দোলনের সময় কবি নিরন্ন মানুষের কান্না প্রত্যক্ষ করেছেন এবং এজন্য সরকারি অত্যাচারকে কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
তাই তাঁর কবিতায় সমকালীন জীবন, স্বদেশ, অবহেলিত মানুষ প্রতিবাদী সুরে ধ্বনিত হয়েছে।তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘গ্রহচ্যুত’প্রকাশিত হয় ১৯৪২-এ। তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থ অথচ ভারতবর্ষ ওদের’ ১৯৮৪-তে প্রকাশিত হয়। তাঁর অন্যতম কাব্যগ্রন্থগুলো হলো ‘ ও রাণুর জন্য, ‘উলুখড়ের দুয়ার, রাস্তায় যে হেঁটে যায়’, ‘মানুষ খেকো বাঘেরা বড় লাফায়, ভিয়েতনাম ঃ ভারতবর্ষ, ‘ভাতে পড়ল মাছি, ‘আমার যজ্ঞের ঘােড়া’ প্রভৃতি।
তরুণ কবিদের প্রতি ছিল গভীর মমত্ববোধ। তাঁদের ভাল কবিতা লেখার প্রেরণা দিতেন, কবিতা নিয়ে নিজেই পাঠিয়ে দিতেন নানা পত্রপত্রিকায়। কলকাতার পোশাকি সভাসমিতির আড়ম্বর উপেক্ষা করতেন, বরং যেতে পছন্দ করতেন গ্রামে-গঞ্জে তরুণ লেখক-কবিদের ছোট সভায়।
তরুণ কবিদের প্রতি ছিল গভীর মমত্ববোধ। তাঁদের ভাল কবিতা লেখার প্রেরণা দিতেন, কবিতা নিয়ে নিজেই পাঠিয়ে দিতেন নানা পত্রপত্রিকায়। কলকাতার পোশাকি সভাসমিতির আড়ম্বর উপেক্ষা করতেন, বরং যেতে পছন্দ করতেন গ্রামে-গঞ্জে তরুণ লেখক-কবিদের ছোট সভায়।
প্রথাগত ছক ভাঙ্গা কবি ছিলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সমাজ রাষ্ট্র দেশকে দেখেছেন পর্যবেক্ষণ করেছেন সর্বজনীন মানুষের প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার বিশ্লেষণে। কবিতাকে ভালোবেসে ছিলেন শুধুমাত্র ভাব জগতে বিচরণ নাম যশ প্রতিপত্তির জন্য নয়, কবিতাকে মন প্রাণে আঁকড়ে ধরেছিলেন সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা হিসেবে, অন্যায় অত্যাচার শোষণ বঞ্চনা নিপীড়ন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াই করতে, কবিতাকে আমৃত্যু সযত্নে বুকে আগলে রেখেছিলেন শান্তি, সাম্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, স্থিতিশীলতা, ভারসাম্য, সো ভ্রাতৃত্ব, সংহতি ঐক্য চিরায়ত অটুট রাখার জন্য, কবিতায় সঁপে ছিলেন ধ্যান-জ্ঞান মন-প্রাণ চিন্তাভাবনা শুধুমাত্র সমাজ ব্যবস্থাটাকে পাল্টানোর জন্য।
তার কবিতার প্রতিটি অক্ষরে, শাব্দিক বুনোটে আপামর মানুষের জীবনযাপনের চিরায়ত প্রতিচ্ছবি। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সামাজিক প্রতিষ্ঠিত খ্যাতি জৌলুস কে দূরে সরিয়ে সাবলীলভাবে এখনো বাঙালি পাঠকসমাজে চিরভাস্বর স্মরণীয়। জন্মদিনে প্রিয় কবির প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি প্রাণ ভরা ভালোবাসা। একটা ইচ্ছে মননে পুষতে ইচ্ছে করে যদি কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মত আরো প্রতিবাদী, মরমী, সামাজিক দায়বদ্ধ, সুদূর চিন্তাভাবনার বাস্তবিক কবি জন্মান সাহিত্য প্রকৃতার্থেই সমাজের প্রতিচ্ছবি দলিলে পুরোদস্তুর পরিণত হবে।