বাঙালী মানসে সম্পাদক সাগরময় ঘোষ

সাগরময় ঘোষ। ছবি: আনন্দবাজার থেকে সংগৃহীত
ছাত্রাবস্থায় সাহিত্য নেশার প্রতি ভালোবাসা থাকায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায প্রকাশিত গল্পকবিতা উপন্যাস, ছোট গল্প প্রবন্ধ পড়তাম। পড়ার ক্ষেত্রে ছিল এক অফুরন্ত ভালোলাগা। বিশেষত সাহিত্য হলে আর কোনো কথায় নেই। সেখানে সর্বাগ্রে ডুবে যেত অবচেতন মনন।বাড়িতে বাবার কাছে প্রথম সুযোগ ঘটে দেশ পত্রিকা পাতা উল্টিয়ে নেড়েচেড়ে দেখার অবশেষে পড়ার। এ যেন জীবনের চরম প্রাপ্তি ।অবশ্যই তার আগেই নাম শুনেছিলাম বাংলা সাহিত্যের একেবারে প্রথম শ্রেণির মননশীল পত্রিকা দেশ। পত্রিকার পাতা উল্টালেই প্রথমেই চক্ষুর সম্মুখে বড় বড় হরফে যার নাম সহজেই উদ্ভাসিত তিনি হলেন সম্পাদক সাগরময় ঘোষ। সাগরের মতই তিনি ছিলেন বিশাল ব্যাপ্তিময় বিশেষত পত্রিকা সম্পাদনায়।
আপন বিচক্ষণতা, বহুমুখীন ব্যক্তিত্ব, সৃজনশীলতা, দক্ষতা, নিবেদিতপ্রাণ মানসিকতা সর্বোপরি গঠনমূলক, কর্মমুখীন জীবন দর্শনে বাংলা সাহিত্যিক সাময়িক পত্রিকা জগতে যে কয়েকজন কালজয়ী, বিদগ্ধ, প্রথম শ্রেণিতে আসীন তন্মধ্যে সর্বজন শ্রদ্ধেয়, সর্বজনপ্রিয়, সর্বজনবিদিত সাগরময় ঘোষ অন্যতম। সাগরময় ঘোষ শুধুমাত্র একটি নাম নয়, একটি প্রতিষ্ঠান, একটি দায়বদ্ধতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, সৃজনশীলতার মিশেল। বিদ্যা বুদ্ধি, মননশীল ক্ষুরধার লেখনির সমন্বয় কীভাবে একটি পত্রিকাকে আপামর পাঠকের সম্মুখে উপস্থাপন প্রতিষ্ঠা করতে হয় তা সাগরময় ঘোষ করে দেখিয়েছেন।
দেশ পত্রিকা সম্পাদনার কাজে নিমগ্ন থেকে তিনি অর্জন করেছিলেন এক প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা। পরিপূর্ণ মনোনিবেশ, সৃজনশীলতা, মানবিক দায়বদ্ধতা, সামাজিক চেতনার উন্মেষ জারিত হয়ে তিনি নিজেকে পুরোদস্তুর সঁপে দিয়েছিলেন এই পত্রিকা সম্পাদনায়। সম্পাদক হিসেবে তাঁর তুলনা তিনি-ই। পত্রিকা সম্পাদনা একটা শিল্প, মননশীল ও সামাজিক বিপ্লব সেটা সুচারুভাবে তিনি সম্পাদনার প্রতিটা ক্ষেত্রে স্বাক্ষর রেখে গেছেন। এ নিয়ে আজও কোনো দ্বিমতের অবকাশ নেই। নিছক সম্পাদনা নয়। সাগরময় ছিলেন প্রকৃতার্থে জহুরি। নিজস্বতা, অন্তঃস্থ চিন্তাভাবনা, উদ্ভাবনা, সৃষ্টিশীলতার মিশেলে তিনি নিজেকে মেলে ধরে ছিলেন সম্পাদনা সৃষ্টিশীল আকাশে। অচিরেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন উদীয়মান লেখকের আশ্রয়দাতা, অবলম্বন, অনুপ্রেরণা।আক্ষরিক অর্থেই মরমী অনুভবে লেখক চিনে নিতে পারতেন তিনি। তাঁর অনুসন্ধানী চোখ বাংলা সাহিত্যের সাগর ছেঁচে অনেক মণিমাণিক্য তুলে এনেছে। যার ফলে সমৃদ্ধ, পরিপূর্ণ, বিকশিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডার। এ কাজে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সম্পূর্ণ।
পশ্চিমবঙ্গের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রান্তিক অবহেলিত অথচ একরাশ সম্ভাবনাময় সৃষ্টিশীল প্রতিভাকে তিনি সসম্মানে সাহিত্যের অঙ্গনে পুনর্বাসিত করেছিলেন। যারা পরবর্তী ক্ষেত্রে সহজাত প্রতিভা বিকাশে নিজেদের মিলিত হয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের শাখা প্রশাখায় ।এখানেই তিনি অনন্য এবং পুরোপুরি সফল। দেশ পত্রিকার সঙ্গে সাগরময়ের সংযোগের সূচনা ১৯৩৯ সালে।

ইংরেজদের বিরুদ্ধে দেশমাতৃকার টানে, ভালোবেসে স্বাধীনতা আন্দোলন করে জেলে গিয়েছিলেন। সেখানেই আলাপ আনন্দবাজার সংস্থার প্রাণপুরুষ অশোককুমার সরকারের সঙ্গে। সেই সময় তিনিও তখন একই কারণে জেলে বন্দি। শান্তিনিকেতনের নিবিড় প্রকৃতিতে রবীন্দ্র-ছায়ায় প্রতিপালিত সাগরময় দরদী গলায় জেলে গান শোনাতেন। গানে,গল্পে, আড্ডায় অল্প সময়ে তাঁদের সখ্য জমে উঠল। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার কিছু দিন পর অশোকবাবুর ডাকে দেশ পত্রিকায় যোগ দিলেন সাগরময় ঘোষ। আনন্দবাজার পত্রিকা ও দেশ-এর কার্যালয় তখন মেছুয়াবাজারের বর্মণ স্ট্রিটে।
কাগজে-কলমে সম্পাদক হয়েছেন অনেক পরে, ১৯৭৬ সালে। সেই দায়িত্ব নিবিষ্টভাবে পালন করেছেন ১৯৯৭-এর অক্টোবর পর্যন্ত। তার পরেও আমৃত্যু অর্থাৎ ১৯৯৯-এর ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি ছিলেন দেশ—এর সাম্মানিক সম্পাদক। কিন্তু এ সব হল দিন-তারিখের নিরস খতিয়ান মাত্র। দেশ—এ যোগ দিয়ে গোড়া থেকেই সম্পাদনার কাজে নিজেকে পুরোদস্তুর জড়িয়ে ফেলেছিলেন সাগরময়। প্রথম থেকে ভাবনা ছিল প্রথিতযশা, বাঙালি সাহিত্য-সংস্কৃতি ধারক ও বাহক, মর্যাদা সম্পন্ন রুচিশীল ও সৃষ্টিশীল সাহিত্য পত্রিকা দেশকে আরও পাঠকের কাছে মননশীল ভাবে পৌঁছে দেওয়া। পাঠকের আকাঙ্ক্ষা, তৃপ্তি, চাহিদা, মানসিক খোরাককে সম্পূর্ণতায় ধাবিত না করে পরবর্তী সংখ্যার জন্য প্রতীক্ষায় মগ্ন থাকা। বলার অপেক্ষা রাখে না এই কাজে তিনি হয়ে উঠেছিলেন একাই কুম্ভ। নিজে বড় একটা লিখতেন না। বরং লেখক সত্তাকে নির্বাসনেই পাঠিয়েছিলেন স্বেচ্ছায়। বেছে নিয়েছিলেন আড়ালে থেকে অন্যের লেখার গুণমান বিচার, নবীন লেখকদের খুঁজে নেওয়া এবং দক্ষতা অনুযায়ী প্রবীণ ও নবীন সকলের কাছ থেকে শ্রেষ্ঠটি আদায় করার কাজ। এ ব্যাপারে অননুকরণীয় ক্ষমতা ছিল তাঁর অনায়াস করায়ত্ত। নবীন-প্রবীণ লেখক সত্তাকে বিকশিত, জারিত, অনুপ্রাণিত করতে সাগরময় ঘোষের প্রচেষ্টা ও কসরত ছিল অপরিসীম। তিনি যখন দেশ পত্রিকা সম্পাদকীয়তে আসীন তখনও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ জীবিত। সেই সময় এক দিকে বিমল মিত্র, প্রেমেন্দ্র মিত্র, প্রবোধ সান্যাল, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলি, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ পরিচিত লেখক। এ যেন বাংলা সাহিত্যাকাশে চাঁদের হাট। অন্য দিকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমরেশ বসু, শংকর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, জয় গোস্বামীর মতো বহু লেখক-কবিকে ‘দেশ’-এর পাতায় পাঠকদের সঙ্গে পরিচয় করানো। দু’টি দায়িত্বই সমান নিষ্ঠা এবং ঐকান্তিকতায় সম্পন্ন করেছেন সম্পাদক সাগরময় ঘোষ। একটি পত্রিকার পিছনে যেভাবে প্রাণশক্তি, মনোভাব, অফুরান কর্মমুখীন মানসিকতা, সর্বোপরি ভাবনার সুদুরপ্রসারি সৃষ্টিশীলতাকে উজার করে দিয়েছিলেন তা বাংলা সাহিত্যের সম্পাদনার ইতিহাসে বিরলতম। জীবন চলার বয়স ও অর্জিত অভিজ্ঞতায় সাগরময় ঘোষ যত সমৃদ্ধ, পরিপূর্ণ হয়েছেন, ঠিক ততটাই জনপ্রিয়তা, প্রসারতা, মননশীলতা, পাঠকের মনোগ্রাহীতা, ভালোলাগা ভালোবাসায় সমৃদ্ধির পথে এগিয়েছে বাঙালির মনন সঙ্গী ‘দেশ’। খোলসা করে ব্যক্ত করলে এক দীর্ঘ সময় জুড়ে ‘দেশ’ এবং সাগরময় ছিলেন একে অপরের পরিপূরক।
পত্রিকাটির সঙ্গেই তাই উচ্চারিত হয়েছে তাঁর নাম। পত্রিকার প্রতিটি পাতাতেই যেন সাগরময় ঘোষের সম্পাদকীয় দায়বদ্ধতার নিপুণতা দক্ষতা মুনশিয়ানা। তাঁর মৃত্যুর ২২বছর পরে এখনও তিনি দেশ পত্রিকার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। সম্পাদকীয় গুণাবলী পরাকাষ্ঠাতে বিচরণ করে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন বাংলা সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদনা জগতে এক ইতিহাস। প্রতিটি প্রতিষ্ঠিত, প্রতিভাশীল লেখকের পিছনে সম্পাদকের ভূমিকা, দায়িত্ব, নিষ্ঠা ঠিক কতটা তার জ্বলন্ত স্বাক্ষর সাগরময় ঘোষ। আপামর সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রিয় বাঙালির মননে শ্রদ্ধায় চির স্মরণীয় হয়ে আছেন সাগরময় ঘোষ। তিনি বাংলা সাহিত্যে পত্রিকার সম্পাদনার জগতে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন এখনো সেই ইতিহাস সম্পাদকদের অনুসরণের সোনালী পথ।
পাভেল আমান, হরিহর পাড়া, মুর্শিদাবাদ, ভারত