বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ২৮

অপেক্ষা তো করতেই হবে! জিলানী এবং জাভেদ পরষ্পর মুখের দিকে তাকালেন। উভয়ে হাসপাতালের দর্শনার্থীদের চেয়ারে গিয়ে বসলেন। পিন্টুও আছে পেছনে। পিন্টুর মোবাইল সেটটা জিলানী নিয়ে নিজের কাছে রেখেছেন যাতে আপাতত: সে বাইরে যোগাযোগ করতে না পারে।
হাসপাতালে আগত সেবা প্রত্যাশী লোকজনের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। বাড়ছে শব্দের গুঞ্জরণও। হাসপাতালে এলে দেখা যায় যে কত মানুষ কতরকম অসুস্থতায় ভুগছে। টের পাওয়া যায় ডাক্তার এবং নার্সের গুরুত্ব। এখানে একজন চিকিৎসক আত্ম নিবেদিত হলে যেন একজন সাক্ষাত অবতার! আবার নীতিভ্রষ্ট হলে ভিলেন!
পিন্টুর কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে ব্যাপারটা। জেরিন ম্যাডামের সাথে কারও শত্রুতা ছিল বলে সে কখনো শোনে নি। ইঞ্জিনিয়ার জাভেদ বলেছেন তিনি জেরিন ম্যাডামকে নদী থেকে তুলে এ হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন। এতো ভালো একজন মানুষকে কারা এবং কেন এতদূরে ধলেশ্বরী ব্রীজে নিয়ে আসবে এবং নদীতে ফেলে দেবে ! নাহ, এসব সে মাথার ভেতরেই নিতে পারছে না!
ইঞ্জিনিয়ার জাভেদ ভাবছেন, জিলানী সাহেব যাকে খুঁজতে এসেছেন এই মহিলা যদি তিনি না হন তাহলে এ প্রচেষ্টা এবং অপেক্ষা বৃথা যাবে।
জিলানী ভাবছেন, সত্যি যেন ১৯ নাম্বার সিটটা জেরিনের হয়। এ পর্যন্ত রেজাউদ্দিন সাহেবের কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি, এখন যদি জেরিনকেও পাওয়া না যায় তাহলে তাঁর তদন্তের তো কোন রেজাল্ট হলো না! শেষ অব্দি ব্যর্থ হবেন এমনটা তিনি ভাবতে চান না। ব্যর্থতা জিলানীকে ভয় পায়— এটা তাঁর একান্ত বিশ্বাস। জেরিনকে এখানেই পাবেন এ বিষয়ে তিনি আশাবাদী এবং তাকে রিলিজ করিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দেবেন এ ব্যাপারে তিনি প্রত্যয়ী।
জিলানীর মোবাইল বেজে উঠল। রাইসের কল। জিলানী একটু নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে কল রিসিভ করলেন।
‘স্যার একটা খারাপ খবর আছে।’
‘খারাপ খবর? কী সেটা ?’
‘গতকাল বিকেলে মি. টিটি জামিনে বের হয়ে এসেছে।’
‘বলো কী! এ তো সত্যিই খারাপ খবর! কেন, আমাদের কোর্ট ইন্সপেক্টর জামিনে জোরাল আপত্তি দেয় নি ?’
‘কি জানি স্যার, আপত্তি দেওয়ার তো কথা। আরেকটা সংবাদ বলি স্যার।’
‘হ্যাঁ বলো।’
‘রিফাতের জামিন করানোর জন্য নিধি আজ কোর্টে গিয়েছিল। সকাল ন’টায় একজন উকিলের সাথে কথা বলেছে। এ উকিল হচ্ছে সে উকিল, যে মি. টিটিকে জামিন করিয়েছে।’
‘বুঝেছি। আর কিছু ?’
‘এরপর নিধি জেলখানায় ঢুকেছিল স্যার। প্রায় আধঘন্টা ছিল। এই একটু আগে বের হয়ে এসেছে।’
‘তার মানে সে রিফাতের সঙ্গে দেখা করেছে। তুমি কি সবকিছু ওয়াচ করে বলছ ?’
‘রাইট স্যার।’
কল শেষ।
জিলানী দেখছেন এক বৃদ্ধা আরেক বৃদ্ধকে নিয়ে একবার এদিক আরেকবার ওদিক যাচ্ছেন। কোথায় কী করতে হবে বুঝতে পারছেন না। বৃদ্ধ অসুস্থ। তারা দুজন স্বামী-স্ত্রী এবং তাদের পরিবারটা দরিদ্র এটা দেখে অনুমান করা যায়। জিলানী উঠে গিয়ে তাদের খবর নিলেন। বৃদ্ধের জন্য আউটডোর প্যাশেন্ট- এর টিকিট কেটে দিলেন। তারপর তাদের আউটডোর ডাক্তারের চেম্বারের সামনে নিয়ে একটা বেঞ্চে বসালেন। সেখানে আরও রুগী অপেক্ষমান। জিলানী তাদের বুঝিয়ে দিলেন কী করতে হবে। বৃদ্ধা জিলানীর মাথায় হাত রাখলেন। কৃতজ্ঞতা মেশানো হাত।
ফিরে এলে জিলানীকে জাভেদ জিজ্ঞেস করলেন,‘এক্স-রে রুমে গিয়েছিলেন ?’
‘না। ওখানে গেলে তো আপনাকে নিয়েই যেতাম। অন্য একটা কাজে গিয়েছিলাম। জাভেদ সাহেব, আপনার অফিসিয়াল কাজের ক্ষতি হচ্ছে না তো ?’
‘না না, আমি আজ আধাবেলা আপনাকে সময় দেবো বলেই এসেছি। এটা তো একটা হিউম্যানিটারিয়ান ওয়ার্ক। ওই লেডিকে তার বাড়িতে ফিরিয়ে দিতে পারলে আমিও শান্তি পাবো।’
‘আচ্ছা, আপনারা যখন তাকে নদী থেকে তুললেন তখন মহিলা কী অবস্থায় পড়ে ছিলেন ?’
‘শরীরটা যেখানে পড়ে ছিল সেখানে পানি ছিল অল্প। নদীর কিনারটায়। ওনার শরীরটা ছিল আধডোবা অবস্থায়। কতোগুলো ভাঙা ইট দেখেছি সেই পানির নিচে।’
‘তার পরনে কী ছিল মনে আছে ?’
‘হ্যাঁ মনে আছে। কামিজ শেলওয়ার।’
‘কোন গয়না, ঘড়ি এসব ছিল ?’
‘এসব তার পরনে আগে ছিল কিনা বলতে পারব না। তবে আমি দেখি নি।’
‘আপনি কি থানায় জানিয়েছিলেন ?’
এমন সময় ইঞ্জিনিয়ার জাভেদের মোবাইলে রিং বেজে উঠল।
‘এক্সকিউজ মি।’ কথাটা বলে তিনি মোবাইলটা ধরলেন। আলাপ সারলেন। এরপর জিলানীর দিকে মুখ করে বললেন,‘অ্যাকচুয়ালি তখন আমার লক্ষ্য ছিল তার জীবন বাঁচানো। সে জন্য যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে ওয়ার্কিং লেবারদের দিয়ে ধরাধরি করে আমার গাড়িতে তুলি। এরপর হাসপাতালে নিয়ে আসি। হাসপাতালের সহকারি রেজিস্ট্রার বলেছিলেন তিনি থানায় ইনফর্ম করবেন। তার কাছে গেলে এটা জানা যাবে। যাবেন ?’
‘যাবো। তার আগে তো ওনাকে পেতে হবে যাকে আমরা খুঁজছি।’
পেছনে বসে পিন্টু সব শুনেছে। সে একেবারে থ হয়ে আছে!
পঁয়ত্রিশ মিনিট পার হলো। জিলানী বললেন,‘চলেন ওয়ার্ডে যেয়ে দেখি।’
‘হ্যাঁ চলেন।’ জাভেদ বললেন।
তখনই জিলানীর মোবাইলে কল এলো।
‘একটু কলটা ধরি?’ জিলানী বললেন।
‘শিওর।’ জাভেদ সাড়া দিলেন।
জিলানী দাঁড়িয়ে একটু দূরে গিয়ে সোহরাবের কলটা রিসিভ করলেন।
‘বলো সোহরাব।’
‘স্যার, গুলিবর্ষণের মামলায় আরেকজনকে ধরা হয়েছে শেওড়াপাড়া থেকে। এটা জেনুইন।’
‘জেনুইন বলতে কী বোঝাচ্ছো?’
‘ঘটনার আগে বছিলা থেকে আপনার বাসায় আর মোবাইলে অজ্ঞাত নাম্বার থেকে যে কল দিয়েছিল, এ সেই লোক।’
‘ভেরি গুড। এবার জানা যাবে এর পেছনে কে বা কারা !’
‘অলরেডি আমি গিয়ে বের করে ফেলেছি স্যার।’
‘তুমি কেন ? থানার লোক পারে নি ?’
‘তারা কি আর বেশি গা লাগাবে ! আমি তো আসামি ধরতেও তাদের হেল্প করেছি। আপনি বোঝেন স্যার।’
‘ক্লিয়ার করো সোহরাব।’
‘যে ব্যাটাকে ধরা হয়েছে সে স্বীকার করেছে যে স্যান্ডোর গ্রুপের।’
‘তার মানে মি: টিটির পোষ্য !’
‘তাই তো দেখি স্যার।’
‘গুলিটা কি সে চালিয়েছে ?’
‘না স্যার। সে আপনার অবস্থানটা জানিয়েছে। তারপর অন্য একজন গুলি চালিয়েছে। গুলিটা যে চালিয়েছে আশা করি তাকে এবার পেয়ে যাবো। জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।’
‘ধন্যবাদ তোমাকে। কথা হচ্ছে, ওসি তো আমাকে একবারও কল দিলো না ! একজন পুলিশ ইন্সপেক্টরের ওপর সশস্ত্র হামলা হলো এটা কি তার কাছে প্রায়োরিটি পাবে না ? আফটার অল উই আর কলিগস্ , অ্যান্ড আই অ্যাম সিনিয়র টু হিম !’
‘কিছু কথা তো কানে আসে স্যার। আপনাকে পরে বলবো।’
‘ঠিক আছে। শোনো, তুমি যা করবে কেয়ারফুলি করবে।’
‘জি স্যার। বুঝতে পেরেছি।’
তিনজন মহিলা ওয়ার্ডের দিকে যাচ্ছেন। এমন সময় এক ভদ্রলোক এসে জাভেদকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ভাই আইসিইউ কতো তলায় ?’
‘আমি বলতে পারবো না।’ জাভেদ উত্তর দিলেন।
জিলানী ভদ্রলোককে নিকটবর্তী কাউন্টার দেখিয়ে বললেন,
‘আপনি ঐ কাউন্টারে জিজ্ঞেস করুন, বলে দেবে।’
‘থ্যাংক ইউ’ বলে ভদ্রলোক কাউন্টারের দিকে গেলেন।
জিলানী, পিন্টু এবং জাভেদ ওয়ার্ডে ঢুকলেন। ১৯ নাম্বার বেড এখনও খালি। জিলানী নার্সকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘সিস্টার, ১৯ নাম্বার বেডের পেশেন্ট এক্স-রে থেকে ফেরেন নি ?’
‘না।’ নার্সের জবাব।
‘এতো সময় লাগে নাকি এক্স-রে করতে ?’ জাভেদ বিরক্তিসহ বললেন।
‘সেটা তো আর আমি জানি না।’ নার্স বললো।
এসময় আরেকজন স্টাফনার্স ভেতরে ঢুকলো। তিনজনকে একসাথে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
‘আপনাদের পেশেন্ট কোনজন ?’
‘এই ১৯ নাম্বার বেডের পেশেন্ট।’ জাভেদ জবাব দিলেন।
‘ও আচ্ছা। পেশেন্টকে ফিজিও থেরাপির জন্য নেয়া হয়েছে। একটু আগে ওনার বড় ভাই এসেও খোঁজ নিয়েছে।’
‘বড় ভাই ! সেই বড় ভাই এখন কোথায় ?’ জিলানী বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
‘বললো তো চা খেয়ে আসছি।’ নার্সের উত্তর।
জিলানী ভাবলেন, জেরিনের তো কোন বড় ভাই নেই ! তাহলে কি এই বেডের পেশেন্ট জেরিন নয় ! নাকি বড়ভাই সেজে কেউ এখানে এসেছিল ! মনে পড়েছে, ফেসবুকের স্ট্যাটাসটা তো ‘পাবলিক’এ পোস্ট করা ছিল ! আশ্চর্য ! জেরিনের নিরাপত্তা অবশ্যই নিবিড় করতে হবে।
‘আপনারা একটু বাইরে যান। ডাক্তার সাহেব রাউন্ডে আছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে এই ওয়ার্ডে চলে আসবেন।’ নার্সের অনুরোধ।
জিলানী এবং জামাল উভয়ে ভাবলেন, ঠিকই তো, মহিলা ওয়ার্ডে তিনজন পুরুষ একসাথে দাঁড়িয়ে থাকা বেমানানই বটে। জিলানী পিন্টুকে ওয়ার্ডের বাইরে গিয়ে থাকার জন্য বলতে যাচ্ছিলেন, তখনই পিন্টু একটা দৌড়ের মতো দিয়ে চিৎকার করে উঠলো—
‘জেরিন ম্যাডাম ! জেরিন ম্যাডাম !’
ভীষণ খুশি পিন্টু ! তার মুখে হাসি চোখে কান্না। মনটা বিহ্বল। সে ইন্সপেক্টর জিলানীর দিকে মুখ করে বললো,
‘স্যার এই তো আমাদের জেরিন ম্যাডাম !’
জাভেদ জিলানীকে বললেন, ‘ওনাকেই আমি হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলাম।’
জিলানী নিষ্পলক তাকিয়ে আছেন। হ্যাঁ ইনিই তো ! ছবির সাথে মিল রয়েছে, যদিও মুখের আদলটা সেরকম সুন্দর নেই। একটা হুইল চেয়ারে ঠেলে ঠেলে একজন আয়া তাকে বেডের কাছে নিয়ে এসেছে। আয়া নিজেই রুগীকে হুইল চেয়ার থেকে কোলে করে তুলে বেডে শুইয়ে দিলো।
‘ম্যাডাম আমাকে চিনতে পেরেছেন ? আমি পিন্টু।’
এ কথা শুনে আয়া পিন্টুকে বললো,
‘জোরে আরাকবার কন। একবার কইলে বোঝতে পারে না।’
পিন্টু আবার জিজ্ঞেস করলো,
‘ম্যাডাম আমাকে চিনেছেন ?’
এবার জেরিন মাথা নাড়লেন। তাঁর চোখ বেয়ে নেমে এলো অশ্রুধারা। জিলানী ও জাভেদ অবাক নয়নে তাকিয়ে আছেন। স্রষ্টার কী লীলাখেলা ! শেষ পর্যন্ত জেরিনকে বাঁচিয়ে রেখেছেন ! জেরিনকে পাওয়া যাবে এ ছিল এক অসম্ভব ব্যাপার, একটা কল্পনা মাত্র। সে কল্পনা এখন বাস্তব। সত্যি, মানুষ কোন কিছু কায়মনোবাক্যে চাইলে এবং চেষ্টা করলে সমগ্র প্রকৃতিও একাত্ম হয় তাকে পাইয়ে দিতে।
পিন্টু জেরিনের সাথে জাভেদ এবং জিলানীকে পরিচয় করিয়ে দিলো।
‘ইনি হচ্ছেন ইঞ্জিনিয়ার জাভেদ সাহেব। ইনি আপনাকে নদী থেকে উদ্ধার করে এখানে নিয়ে এসেছেন।’ জেরিন জাভেদের দিকে তাকালেন। জাভেদ বললেন,
‘কেমন আছেন এখন ?’
জবাবে জেরিন কিছুটা বললেন। কিন্তু কথাটা বোঝা গেলো না।
‘ইনি সিআইডি ইন্সপেক্টর জিলানী সাহেব। স্যার আপনাকে তালাশ করে বের করেছেন। মামলা তদন্ত করছেন। কয়েকজনকে গ্রেফতার করে জেলে ঢুকিয়েছেন।’ পিন্টু বললো।
জেরিন জিলানীর দিকে তাকালেন। তাঁর চোখ আবারও ছলছল করে উঠলো। জিলানীর চোখও ভিজে যাচ্ছে।
‘বাড়ি যাবেন ? আপনার বাড়িতে ? ধানমন্ডি ?’
জিলানী জানতে চাইলেন। জেরিন হাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। কিছু একটা বললেনও, কিন্তু বোঝা গেলো না।
‘ওনার কথা জড়িয়ে যায়। এক মাস অজ্ঞান ছিলেন তো ! এখন তাও কথা বুঝতে পারেন, বলার চেষ্টাও করেন, এক সপ্তাহ আগেও দেখেছি কিছু বললে শুধু চেয়ে থাকতেন।’ নার্স বললো।
এ সময় জাভেদের মোবাইলে কল এলো। জাভেদ কল রিসিভ করে বললেন, ‘এই তো, আধঘন্টার মধ্যে আসছি।’ তারপর জিলানীকে বললেন, ‘আমি কি এবার যেতে পারি ? আমাকে সাইটে যেতে হবে।’
‘আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে শেষ করা যাবে না। আপনি জানেন না কী মহৎ একটা কাজ আপনি করেছেন ! মানুষের জন্য সরাসরি এমন অবদান সব মানুষ রাখতে পারে না। আপনার জন্য অনেক শুভকামন। আবার দেখা হবে। আপনার ভিসিটিং কার্ডটা দিয়ে যান প্নিজ।’ জিলানী বললেন।
ইঞ্জিনিয়ার জাভেদ ইকবাল তাঁর একটা ভিসিটিং কার্ড জিলানীর হাতে দিলেন। যাবার সময় বললেন, ‘আপনি যদি মনে করেন কোর্টে আমাকে সাক্ষ্য দিতে হবে, আমি দেবো।’
ইত্যবসরে রাউন্ডে চলে এলেন সহযোগী অধ্যাপক ডা: অর্নব শুভ। বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটা। ইন্সপেক্টর জিলানী তাঁকে নিজের পরিচয় দিলেন। তারপর এখানে আসবার কারণ জানালেন। সব শুনে ডাক্তার সাহেব নার্সকে বললেন,
‘মিস সোহেলীকে আসতে বলুন।’
ডা: অর্নবও নিজের পরিচয় দিলেন। জেরিনের বর্তমান শারীরিক অবস্হাটা দেখতে দেখতে জিলানীকে বললেন,
‘ইন্সপেক্টর সাহেব, এই রুগী সাতাশ দিন কোমায় ছিল। জ্ঞান ফিরেছে তাও প্রায় এক মাস। কিন্তু পুরোপুরি অচল ছিল। না মুভ করতে পারতো, না রেসপন্স করতে পারতো।’
‘এতোদিন কোমায় থাকার কারণ কী হতে পারে ?’ জিলানী জিজ্ঞেস করলেন। ডাক্তার জানালেন,
‘শুনুন, তাকে যে পরিমাণে ঘুমের অষুধ খাওয়ানো হয়েছিল তাতেই সে মরে যেতে পারতো, কিন্তু প্রভু বাঁচিয়েছে। এরপর তাকে ব্রীজ থেকে নিচে ফেলে দেওয়ায় শক্ত জিনিসের ওপর পড়ে গিয়ে তার মাথার বাম দিকে ‘সেরিব্রাল হেমিসফেয়ার’ আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে যায়। ফলে তার ডান সাইড পুরোটা প্যারালাইজড হয়ে গেছে। চেষ্টা চলছে ফিজিওথেরাপি দিয়ে রিকোভার করার।’
‘আপনাদের এ মানবিক চেষ্টা ও আন্তরিক সেবা সত্যিই প্রশংসনীয়।’ জিলানী বললেন।
‘প্রশংসা তো মূলত মিস সোহেল পাওয়ার যোগ্য। হাসপাতাল তো অজ্ঞাত কোন রোগীকে এতোদিন বেডে রাখতে পারে না। মিস সোহেলীর আন্তরিক উদ্যোগ থাকাতে এই রুগীকে সার্ভিস দেওয়া সম্ভব হয়েছে।’ ডাক্তার বললেন।
‘মিস সোহেলী কে ?’ জিলানী জানতে চাইলেন।
‘হাসপাতাল সমাজসেবা কর্মকর্তা। উনি আসছেন। একটু ওয়েট করুন।’ ডাক্তার জানালেন।
অধ্যাপক ডা: অর্নব তাঁর রাউন্ড শেষে চলে গেলেন। জিলানীকে বলে গেলেন যে রুগীকে রিলিজ করিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন।

কিছুক্ষণ পর হাসপাতাল সমাজসেবা কর্মকর্তা মিস সোহেলী জাহান এলেন। জিলানীর সাথে পরিচয় হলো।
সোহেলী বললেন, ‘আমি মূলত সমাজসেবা অধিদফতরের কর্মকর্তা। হাসপাতালে রুগী কল্যাণ তহবিল নামে একটি ফান্ড থাকে যা থেকে দরিদ্র রুগীদের ঔষধ, মেডিকেল টেস্ট প্রভৃতিতে আর্থিক সহায়তা করা হয়। জেরিনের সিরিয়াস অবস্হা দেখে কমিটির সদস্য-সচিব হিসেবে আমি নিজ থেকে তার চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ব্যয়ভারের দায়িত্ব নিয়েছি। তাকে একটি হুইল চেয়ারের ব্যবস্হা করে দিয়েছি। বর্তমানে ফিজিওথেরাপির কাজটাও আমি করাচ্ছি।’
জিলানী তুষ্টচিক্তে সমাজসেবা কর্মকর্তার এ উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করলেন। তারপর বললেন,
‘আমি রুগীকে রিলিজ করিয়ে নিয়ে যাবো। অ্যাম্বুলেন্সে নেয়াই ঠিক হবে। সাথে একজন আয়ারও দরকার হবে। আপনার হুইল চেয়ারটা কি আমাকে ধার দেবেন ম্যাডাম ? আমি পরে ফেরত দেবো।’
‘ঠিক আছে নেবেন, এটা তার দরকার হবে। তবে আপনাকে কিছু কাগুজে ফরমালিটি পূরণ করতে হবে। রুগী আপনি নিয়ে যাচ্ছেন এটা থানাকেও জানাতে হবে।’ সোহেলী বললেন।
‘সেটা জানি। যা যা করা লাগে আমি করবো। আপনাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা ম্যাডাম।’ জিলানী বললেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন,
‘একটা কথা। রুগীর নামটা কী তা জেনেছেন ?’
‘আর বলবেন না। সে তো পরিষ্কার করে কোন কথা বলতে পারে না, লিখতেও পারে না। আমার মোবাইলটা দিয়ে দেখেছি, মোবাইলও প্রেস করতে পারে না। কোন ফোম নাম্বারও তার মনে নেই। ডান দিকটা প্যারালাইজড যে ! বাম হাতে সে লিখতে পারে না। তারপরও অনেক চেষ্টা একদিন তার বাম হাত ঘুরিয়ে নাম লিখতে বলি। দুই ঘন্টা চেষ্টা করে বিশাল আকারে লেখে— জেরিন। এরপরই সে অজ্ঞানের মতো হয়ে পড়ে। আর কিছু লেখানোর চেষ্টা করি নি।’
‘জানেন, জেরিন ম্যাডাম খুব মেধাবী। তিনি একটা নামকরা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক। নীতিবান ভালো মানুষ।’
‘ও আচ্ছা। শুনুন, বাড়িতে ফিজিওথেরাপির ব্যবস্হা করবেন। রেগুলার দিতে পারলে আশা করি ভালো হয়ে যাবেন।
অত:পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে দেখা করে ইন্সপেক্টর জিলানী রুগীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ এবং নাম ঠিকানা দিলেন। জেরিনের ছাড়পত্র নিলেন। ডা. অর্নব শুভর সাথে দেখা করে চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ করলেন। তারপর জেরিনকে অ্যাম্বুলেন্সের বেডে শুইয়ে ঢাকার দিকে রওয়ানা দিলেন। জেরিনের সাথে একজন আয়াকে রেখেছেন। আর সামনের সিটে রেখেছেন তাঁর ওয়াচারকে।
পেছনে পিন্টুকে সাথে নিয়ে ছুটে চলেছে ইন্সপেক্টর জিলানীর জীপ। ভিকটিম জেরিনকে উদ্ধার করে তার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন, একথা ভেবে অবর্ণনীয় প্রশান্তিতে জিলানীর মন।
{চলবে}
আরও পড়ুন :
বিধ্বংসী প্রহর,পর্ব-১
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ২
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ৩
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৪
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৫
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৬
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৭
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৮
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৯
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ১০
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ১১
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ১২
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ১৩
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ১৪
বিধ্বংসী প্রহর,পর্ব— ১৫
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ১৬
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ১৭
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ১৮
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ১৯
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ২০
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব—২১
বিধ্বংসী প্রহর,পর্ব—২২
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ২৩
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব—২৪
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ২৫
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ২৬
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ২৭