বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব—২৪

সূর্যের তেজও একসময় স্তিমিত হয়ে আসে। বাঘের ক্ষিপ্রতাও থিতিয়ে যায়। তেমনিভাবে কথিত দুর্ধর্ষ স্যান্ডোও এখন শীতের সরোবরের মতো শান্ত। অবস্থাই অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
আজ স্যান্ডো এবং মি.টিটিকে কোর্টে পাঠাতে হবে। শেষবারের মতো স্যান্ডো ইন্সপেক্টর জিলানীর জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন। ইতোমধ্যে কঠোর জিজ্ঞাসাবাদের ফলে সে জেরিনের ঘটনায় নিজের সম্পৃক্ততা স্বীকার করেছে। বলেছে সবই সে টাকার জন্য করেছে। কতো টাকা ? পাঁচ লক্ষ টাকা। টাকাটা কে দিয়েছে ? কার হুকুমে এবং প্ররোচনায় এমন জঘন্য কাজ করেছে ? এসব এপর্যন্ত জানায় নি, তবে এখন জানাবে বলেছে। এ মূহর্তে তার নাকি খুব ইচ্ছে করছে এক ক্যান হেনিকেন বিয়ার খেতে আর প্রাণভরে সিগারেটে টান মারতে !
জিলানী বিয়ার দিতে অসম্মতি প্রকাশ করেছেন, তবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহের স্বার্থে একটা সিগারেট দিতে রাজী হয়েছেন। শর্ত হলো সিগারেট তাঁর সামনে খেয়ে শেষ করতে হবে। সময় দিয়েছেন সর্বসাকুল্যে কুড়ি মিনিট।
অন্যদিকে খসরু গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে বেশ অস্বাভাবিক আচরণ করা শুরু করেছে। এটা নাকি ‘স্ক্যারি সিন্ড্রম’ যা অত্যধিক ভয় থেকে সৃষ্ট। সে কারণে তাকে এখনও অফিসিয়ালি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় নি। খসরুকে সাত দিনের রিমান্ডে আনা হয়েছে।
জিলানী ঠিক একুশ মিনিট পর স্যান্ডোকে জিজ্ঞাসা করলেন,‘এখন একটু ভালো লাগছে না?’
‘জী, খুব শান্তি লাগছে।’ স্যান্ডো জবাব দিলো।
‘এবার বলো, জেরিনকে ধলেশ্বরী ব্রীজ থেকে নিচে ফেলে দেওয়ার জন্য কে বলেছিল? কেন বলেছিল?’
‘আমার বস তওফিক তালুকদার সাহেব আমাকে বলেছিল, ‘রিফাত সাহেব তোমাকে কিছু বলবে, শুনো। পারলে কাজটা করে দিও।’ আমি রিফাত ভাইর সাথে দেখা করলে সে ওই কাজের জন্য পাঁচ লাখ টাকা অফার করে। আমি রাজী হই।’
‘টাকা পুরোটা পেয়েছ না ?’
‘হ্যাঁ। কাজের আগে অর্ধেক, শেষে বাকিটা।’
‘ড্রাইভার রোমেলকে কোন টাকা-পয়সা দেয় নি ?’
‘তাকেও এক লাখ দিতে চেয়েছে। সে নিতে আসে নি। ও একটা ভীতুর ডিম !’
‘রিফাত কেন এমন করলো ?’
‘আমি যতদূর শুনেছি, রেজাউদ্দিন সাহেবের ধানমণ্ডির বাড়ি হ্যান্ডওভার নিয়ে তাদের ভেতরে একটা বড় গণ্ডগোল ছিল। জেরিন ছিল এটার মূল বাধা। তাকে সরিয়ে দিতে পারলে পুরো সম্পত্তি রিফাতদের। এ জন্য জেরিন যে রাতে বিদেশ যাওয়ার কথা, সেই রাতটাকে বেছে নেয়া হয়। আগেই প্লান করে সিঁড়িতে তেল ছিটিয়ে ড্রাইভার পিন্টুকে সিঁড়িতে ফেলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে যাতে রিফাত ভাই নিজে গাড়ি চালিয়ে সাথে ভাবীকে নিয়ে যেতে পারে।’
‘সিঁড়িতে তেল ছিটিয়ে রেখেছিল এটা তুমি কি করে জানলে ?’
‘কেন, মোচন আমাকে বলেছে। রিফাত ভাই নিজেই এটা করেছিল। মোচন মেইন দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে ফেলেছিল।’
জিলানী হঠাৎ থেমে গেলেন। তিনি যেন শুনেছেন একটু আগে স্যান্ডো ‘ভাবী’ শব্দটা ব্যবহার করেছে। স্যান্ডোর চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলেন,‘এক মিনিট। তুমি একটু আগে কী বললে যেন? রিফাত নিজে গাড়ি চালিয়ে ভাবীকে সাথে নিয়ে গেছে? ভাবী মানে কি রিফাতের স্ত্রী?’
‘জী।’
‘ইয়ার্কি করছো আমার সাথে? ‘ জিলানী রেগে গেলেন। তারপর বললেন, ‘রিফাতের স্ত্রী তো আমেরিকায়!’
‘আমি কি এলিটা ভাবীর কথা বলছি?’
‘তাহলে ? কার কথা বলছ ?
‘ছয় মাস আগে রিফাত ভাই মগবাজার কাজী অফিসে যাকে গোপনে বিয়ে করে কথাটা গোপন রেখেছে আমি তার কথা বলছি।’
‘আহা, কে সে? নাম কী তার?’
‘নিধি।’
জিলানী এটাই সন্দেহ করছিলেন। ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা তো রয়েছেই, বিশেষ করে যেদিন তিনি নিধির দখলে অনেকগুলো জন্মনিরোধক ট্যাবলেট দেখতে পান সেদিন তাঁর সন্দেহ আরও গাঢ় হয়েছিল। যদিও এ ব্যাপারে কেউ মুখ খোলে নি। আজ সন্দেহটা জাসটিফাইড হলো। আইন বলে, দ্বিতীয় বিয়ে করার আগে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নেয়া প্রয়োজন। হতে পারে এ কারণে বিয়ের বিষয়টা গোপন রাখা হয়েছে। এবার এটা পরিষ্কার হলো যে নিধিকে কেন্দ্র করেই রিফাত-এলিটার বিবাদ। তাহলে এটাও ঠিক যে, রেজাউদ্দিন সাহেবের সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়ার সমগ্র পরিকল্পনা রিফাত-নিধির যৌথস্বার্থে ও যৌথভাবে কৃত!
আজ পিন্টুকে আদিল ভেতরে ঢুকতে দিয়েছে। গাড়ি চেক করার পর পিন্টু ঘরের দরজায় গিয়ে নিধিকে ডাক দিল। নিধি এসে দরজা খুললো বটে, কিন্তু পিন্টুর দিকে তাকাল না। পিন্টু দেখলো নিধি তাকে পাত্তা দিচ্ছে না। আগে চা দেবে কিনা জিজ্ঞেস করতো, ইদানিং তাও করে না। নিধি হয়তো তাকে ভুল বুঝছে। অথবা কখনও তাকে বোঝেই নি, কেবল ইশারায় নাচিয়েছে।
‘নিধি শোনো।’ পিন্টু পেছন থেকে ডাক দিলো। নিধি দাঁড়িয়ে গেল।
‘তুমি কি আমার ওপর রেগে আছ?’ পিন্টু জিজ্ঞেস করল। কিন্তু নিধি কোন উত্তর দিল না। পিন্টু আবার বলল, ‘বিশ্বাস করো, আমি জিলানী সাহেবকে তোমার বিরুদ্ধে, বা কারও বিরুদ্ধে কিছু বলি নি।’
‘তোমাকে এক লাখ টাকা দিয়েছিলাম। সেটা এখনো ফেরত দাও নি। তুমি কি চাও ওই টাকার জন্য আমি জবাবদিহি করি?’ নিধি নিরস গলায় কথাটা বলল। সে গাছের টবগুলোতে পানি দেওয়া শুরু করেছে।
পিন্টু ভাবল, তবে কি এজন্যই নিধি অসন্তুষ্ট! কিন্তু এক লক্ষ টাকা খুব তাড়াতড়ি সে কোথায় পাবে! ভারী মুশকিলেই পড়ল সে!
‘দোকান থেকে কি কিছু এনে দিতে হবে?’ পিন্টু জিজ্ঞেস করল।
‘না।’ জবাবটা দিয়েই নিধি ঘরের ভেতরে চলে গেল।
নিধির মেজাজটা ভালো না। তাই পিন্টু আরও কিছু বলে নিধিকে বিরক্ত করতে চাইল না। সে জানে, নিধি যদি রেগে যায় ভয়ানক রেগে যায়। তাছাড়া এখন তো এক অর্থে নিধিই তার বস!
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। ইন্সপেক্টর জিলানী অফিসে বসে ল্যাপটপের কাজ করছেন। নিধির কথাও ভাবছেন। ওই মহিলা যেমন বুদ্ধিমতি তেমনই ধূর্ত ! চাতুর্যপূর্ণ যা কিছু করে, সন্তর্পণে করে। কালই কাজী অফিসে গিয়ে রিফাত-নিধির গোপন বিয়ের প্রমাণপত্র সংগ্রহ করতে হবে। আসামি খসরুর বক্তব্য নিধির চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারণ করবে। যদিও নিধির বিরুদ্ধে প্রাথমিক সাক্ষ্যসাবুদ হাতে এসে গেছে।
মোবাইলে রিং হলো। ধামরাই থানার ওসি সাহেবের, অর্থাৎ তাঁর বন্ধুর কল।
‘শোনো দোস্ত, মানিকগঞ্জ সদরের ওসি বলেছে, জানুয়ারিতে ধলেশ্বরী নদী থেকে তারা দুজন মহিলাকে উদ্ধার করেছে- একজন মৃত, আরেকজন জীবিত।’
‘তারপর দোস্ত ?’
‘জীবিত মহিলার নাম রোজিনা। সে নাকি সুইসাইডের চেষ্টা করেছিল।’
‘হতে পারে জেরিন নামটা শুনতে শুনতে এবং বলতে বলতে রোজিন বা রোজিনা হয়ে গেছে ! সুইসাইড অ্যাটেম্পট্ এর কথা হয়তো অনুমানে বলা হচ্ছে। আচ্ছা সে এখন কোথায় ?’
‘পুবাইল ভবঘুরে সেন্টারে আছে। তার নাকি কেউ নেই।’
‘ওসি সাহেব উদ্ধারকৃত সেই মহিলার কি কোন ছবি দিয়েছে ?’
‘না। আমি ওনাকে বলেছি।’
‘তুমি আবার চেষ্টা করো। ছবি পাওয়া গেলে আমার হোয়াটস্-অ্যাপে পাঠিয়ে দেবে। ঠিক আছে দোস্ত ?’
‘সিওর। খোদা হাফেজ।’
জিলানী কেমন যেন থ্রিল অনুভব করছেন ! মনে মনে বললেন—জেরিন সত্যিই যেন বেঁচে থাকে!
অফিস সহায়ক দিদার এক কাপ চা এনে টেবিলে রাখল। চা দেখে জিলানীর মনে পড়ল সাজিয়া বলেছে গুঁড়োদুধ, চা পাতা ও নাগেটস নিয়ে আসতে। এ জন্য তাকে কোন সুপারশপে যেতে হবে। পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে দেখলেন। টাকা তেমন নেই। তাতে কী, ক্রেডিট কার্ড তো আছে!
মোবাইলটা বেজে উঠলো। জিলানী দেখলেন নাম্বারটা তাঁর অপরিচিত। তবুও কলটা রিসিভ করলেন। যদি কারও কোন তথ্য দেওয়ার থাকে ! কিন্তু কয়েকবার হ্যালো বলার পরেও ওপাশ থেকে কোন সাড়া নেই। জিলানী আজকের মতো কাজ গুটিয়ে নিচে নেমে গেলেন। জীপে উঠে ড্রাইভারকে বললেন, ‘সুপার শপে চলো।’
ড্রাইভার কায়েস জানে কোন্ সুপার শপে যেতে হবে।
ইন্সপেক্টর জিলানী যা যা নেয়ার শেলফ থেকে নিজে তুলে নিয়ে বাস্কেটহাতে কাউন্টারে গেলেন। ক্রেডিট কার্ড বের করে ক্যাশ কাউন্টারে দিলেন।
‘স্যার ভালো আছেন?’ ক্যাশ কাউন্টারের মহিলা জিলানীকে বলল। জিলানী একটা স্মিত হাসি দিয়ে বললেন, ‘ভালো।’ এ মহিলাকে তিনি কোথায় যেন দেখেছেন, কিন্তু মনে করতে পারছেন না। সে জিলানীর দিকে তাকিয়ে বলল,‘আমাকে চিনতে পেরেছেন ? সেই যে হাতিরঝিলে আপনি হাইজ্যাকারদের মেরে আমার ব্যাগ উদ্ধার করে দিয়েছিলেন!’
এবার জিলানীর স্মরণ হলো। হেসে বললেন,‘ও আচ্ছা, আপনি এখানে জয়েন করেছেন ?’
‘জী। আবার এভাবে দেখা হয়ে গেলো। আপনার কথা প্রায়ই আলাপ হয়। সব পুলিশ অফিসার যদি আপনার মতো হতো, দেশে কোন ক্রাইমই থাকতো না ! সত্যি, আপনি একটা রোল মডেল।’
‘থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ’ বলে জিলানী ক্যাশ-স্লিপে একটা স্বাক্ষর দিলেন। তারপর ‘ভালো থাকবেন’ বলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসছিলেন, মহিলা পেছন থেকে বলল, ‘আবার আসবেন স্যার।’
রাত ন’টা। জীপটা সুপারশপের সামনে একটা সরু রাস্তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। স্থানটা আলো আঁধারি। ইন্সপেক্টর জিলানীর হাত থেকে শপিং ব্যাগটা নিয়ে ড্রাইভার গাড়ির ভেতরে রাখল। এরপর গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে বসে পড়ল। জিলানী সব সময়ই সামনের সিটে বসেন। আজও উঠে বসলেন।
ড্রাইভার কায়েসের বাম হাত জীপের স্টিয়ারিংয়ে। সে গাড়ি স্টার্ট দিল। এবার এক্সেলেরেটরে চাপ দেবে। তার ঠিক বাম দিকে জানালার পাশে উপবিস্ট ইন্সপেক্টর জিলানী। ভাবছেন পিঠটা একটু সিটের সাথে এলিয়ে দেবেন।
ঠট্টাস্… করে হঠাৎ একটা গুলির শব্দ হলো ! মুহূর্তেই গুলিটা জিলানীর জানালা ভেদ করে ভেতরদিকে..!
[চলবে]
আরও পড়ুন :
বিধ্বংসী প্রহর,পর্ব-১
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ২
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ৩
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৪
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৫
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৬
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৭
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৮
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৯
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ১০
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ১১
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ১২
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ১৩
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ১৪
বিধ্বংসী প্রহর,পর্ব— ১৫
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ১৬
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ১৭
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ১৮
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ১৯
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ২০
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব—২১
বিধ্বংসী প্রহর,পর্ব—২২
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ২৩