মায়ের গয়নার বাক্স, পর্ব-৭

মে মাসের প্রথম দিক। ১৯৭১ সাল। সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধ ভালোভাবে শুরু হয়ে গেছে। এই ছোট্ট মফস্বলে এখন পর্যন্ত কিছু না ঘটলেও যেকোনো মুহুর্তে এখানেও হানা হানবে নেকড়ে হানাদার বাহিনী। দলে দলে লোক মফস্বল ছেড়ে গ্রামের দিকে যাচ্ছে। ফকরুল সাহেব ঠিক করেছেন তিনি এখান থেকে কোথাও নড়বেন না। কি হবে উদ্বাস্তুর মত এখানে সেখানে যেয়ে ? মরণ যেখানে আসবার এমনিতেই আসবে। তাছাড়া ইয়াসিরের এখনও কোন খোঁজ নেই। কি যে হলো ছেলেটার? কেন যে ঐ সময়ে ও ঢাকা গেল? এদিকে হানাদাররা চারপাশে ধ্বংসযজ্ঞের মরণ খেলায় মেতেছে। লুটতরাজ, লুন্ঠন ,অরাজকতা শুরু হয়েছে চারপাশে। বাড়ি থেকে সব যুবক, তরুণদের ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করছে। কিশোরী, তরুণী, মহিলা এদের ক্যাম্পে তুলে নিয়ে যাচ্ছে৷ আর এসব হতভাগীনিদের ওপর চালাচ্ছে পাশবিক নির্যাতন। কপাল পোড়া শ্লীলতা হারানো এসব অসহায় নারীদের তারা নাম দিয়েছ গণিমতের মাল। আর এসমস্ত ন্যাক্কার জনক কাজে এদের সাহায্য করছে এই বাংলার মাটিতে জন্ম নেওয়া কিছু বেঈমান। আলবদর রাজাকার বাহিনী। পাকিস্তানিদের পা চাটা গোলাম। টিক্কাখান পূর্ব পাকিস্তানে রাজাকার অর্ডিন্যান্স /১৯৭১ জারি করে এই নিমকহারাম রাজাকার বাহিনী গঠণ করেছে এবং সেই সাথে এদের মিত্র দলগুলোর মাধ্যমে শিক্ষিত দালালদের নিয়ে ‘আলবদর বাহিনী’ গড়ে তুলেছে। সেদিন মকবুলের ছেলেটা ঢাকা থেকে এসে বলল, সে নাকি শুনেছে ঢাকার ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে আলবদর রাজাকার বাহিনী ওদের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে এই বেঈমানগুলিকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। কি আশ্চর্য! নিজের মাটির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা৷ অবলীলায় এরা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দিচ্ছে। মাথায় লালপট্টি বেঁধে নেওয়া এসব শান্তি কমিটির শয়তানগুলি তরুণ যুবকদের বেয়নটের আঘাতে মেরে ফেলছে। কিশোরী যুবতীদের ধরে আর্মিদের ক্যাম্পে পাঠাচ্ছে তাদের অত্যাচার করার জন্য। লুন্ঠন চালাচ্ছে। ঘরবাড়ি দোকানপাট সব আগুনের লেলিহান শিখাতে পুড়িয়ে দিচ্ছে।
ফরিদপুর, মৌলভীবাজার, এসব জায়গাতে নাকি বিহারীদের সাহায্যে পাকিস্তান বাহিনী অনেক হিন্দু জনতা ব্যবসায়ীদের ধরে নিয়ে কখনও নদীর ধারে, তো কখনও ব্রীজের সামনে দাঁড়া করিয়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করছে। কোনরকম সৎকার কার্য ছাড়াই হতভাগ্যদের লাশ পানিতে ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে। ঢাকার একটি সামরিক ছাউনিতে পাঞ্জাবী সেনারা বিশ একুশ জনের মত যুবতীকে ধরে এনে দিনের বেলা বলাৎকার করে উলঙ্গ করে রেখে দেয়।
ফরিদপুর, মৌলভীবাজার, এসব জায়গাতে নাকি বিহারীদের সাহায্যে পাকিস্তান বাহিনী অনেক হিন্দু জনতা ব্যবসায়ীদের ধরে নিয়ে কখনও নদীর ধারে, তো কখনও ব্রীজের সামনে দাঁড়া করিয়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করছে। কোনরকম সৎকার কার্য ছাড়াই হতভাগ্যদের লাশ পানিতে ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে। ঢাকার একটি সামরিক ছাউনিতে পাঞ্জাবী সেনারা বিশ একুশ জনের মত যুবতীকে ধরে এনে দিনের বেলা বলাৎকার করে উলঙ্গ করে রেখে দেয়। এসবে কিনা সাহায্য করছে ঐ রাজাকার বাহিনী। কি করে পারে ওরা? তার ওপরও ভয়ংকর ব্যাপার হলো, এসব ওরা করছে নিজেদের খাঁটি মুসলমান হিসেবে পরিচয় দিয়ে। সারা শরীরে সুন্নতের চিহ্ন ধারণ করে এসব কুকীর্তি করে বেড়াতে ওদের বিবেকে বিন্দুমাত্র বাঁধছে না। এরা কি আসলেই সত্যি মুসলিম? কোন মুসলমান কি আরেক মুসলমানের জান নিতে পারে? কেড়ে নিতে পারে কোন নারীর সম্ভ্রম? ইসলাম ধর্ম কি দিয়েছে কোন মুসলিমকে বিধর্মীদের ওপর অত্যাচার করার কোন অনুমতি? কোরআনের পাকিস্তান কালাম যাদের পথের কাণ্ডারি তারা কি ভুলেও কখনও এমন কাজ করবে? পারবে পবিত্র ধর্মটাকে এভাবে কলুসিত করতে? না, এরা কোন মুসলিম না। শুধু ইসলাম নয়, এরা কোন ধর্মেরই না। এদের ধর্ম পরিচয় একটাই, এরা নরপিশাচ। হাতের মুঠি শক্ত হয়ে আসে ফকরুলের। বৃদ্ধ শরীরের ধমনীতে বয়ে যাওয়া শীতল রক্তে যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠে। এসব খবরে চোখ ফেটে আসে, কিন্তু কোন অশ্রু ঝড়ে না। মনে মনে ফকরুল বলে ওঠে
: হে আল্লাহ, তুমি রহম কর, মাবুদ। কিভাবে আর কত সহ্য করবে মানুষ?
রেডিও তে শোনা গেল পাকিস্তান বাহিনীকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন ঢাকার মুসলিম লীগের নেতা এম. এ সবুর। কৃষক-শ্রমিক পার্টির নেতারা দাবি জানাচ্ছেন, পূর্ব পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে ভারতের হস্তক্ষেপের প্রচেষ্টাকে দাঁত ভাঙা জবাব দিয়েছে পাকিস্তান। কতিপয় জামাতে ইসলামী এবং মুসলিম লীগ নেতাদের পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখার বিশেষ চেষ্টারও খবর পাওয়া যায়। ঢাকাতে চীনের কনসাল জেনারেল মি চ্যাং ইং বলেন —“পূর্ব পাকিস্তানের সৃষ্ট বর্তমান অবস্থা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন ব্যাপার।”
রেডিও তে শোনা গেল পাকিস্তান বাহিনীকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন ঢাকার মুসলিম লীগের নেতা এম. এ সবুর। কৃষক-শ্রমিক পার্টির নেতারা দাবি জানাচ্ছেন, পূর্ব পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে ভারতের হস্তক্ষেপের প্রচেষ্টাকে দাঁত ভাঙা জবাব দিয়েছে পাকিস্তান। কতিপয় জামাতে ইসলামী এবং মুসলিম লীগ নেতাদের পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখার বিশেষ চেষ্টারও খবর পাওয়া যায়। ঢাকাতে চীনের কনসাল জেনারেল মি চ্যাং ইং বলেন —“পূর্ব পাকিস্তানের সৃষ্ট বর্তমান অবস্থা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন ব্যাপার।”
বেগম আখতার সোলায়মান করাচিতে তার দেওয়া এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের সামরিক অভিযানের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধুর বিচারের জন্য গঠণ করা হয়েছে ইসলামামাবাদে এক বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। তাকে রাখা হয়েছে মিয়ানওয়ালি কারাগারে। বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবারকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে ধানমন্ডির ১৮ নং বাড়িতে। লাখ লাখ শরণার্থী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম ও মেঘালয়ের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। শরণার্থীরা তীব্র পানি সংকটে ভুগছে। সঠিক পয়ঃনিষ্কাশনের আর বিশুদ্ধ পানির অভাবের কারণে কলেরা তীব্রাকার ধারণ করেছে। গোসল জানাজা ছাড়াই দাফন হচ্ছে লাশ। ফকরুলের দীর্ঘ নিঃশ্বাসের সাথে বলে ওঠেন, “হায়রে ক্ষমতা! হায় রে বিশ্ববিবেক!”
সামনের মাঠের ভাঙা প্রাচীরের গায়ে কিছু তরুণদের পোস্টার সেঁটে দিতে দেখা যায়। পটুয়া কামরুল হাসানের আঁকা একটি ছবি তাতে জানোয়ারের মত দেখতে একটা মানুষের মুখ নিচে লিখা —“এই জানোয়ারকে খতম করতে হবে।” ঘন ঘন শ্বাস পড়তে থাকে ফকরুল সাহেবের। মনের ভেতর থেকে বজ্রকন্ঠে কে যেন বলে উঠল: এদের সবকটিকে শেষ করতে হবে। যে করেই হোক করতে হবেই হবে।
হঠাৎ মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায় ফকরুল সাহেবের আচ্ছা ইয়াসির যুদ্ধে যায় নি তো? বাড়ির সামনে দিয়ে একটা মিছিল যাচ্ছে। মিছিলের সামনে যে দাঁড়িয়ে সে জোরে জোরে জয়বাংলা বলছে আর তার পাশের দুজনের হাতে বিশাল বড় স্বাধীন বাংলার পতাকা। যখন সামনের জন বলছে “জয়বাংলা”। তখন পেছনের বাকি সবাই একসাথ বলছে “জয়বাংলা” কি দুর্দান্ত শুনতে স্লোগানটা। বাড়ির বাম দিকের বাউন্ডারি ঘেঁষে যে বিশাল আম গাছটা তার পাশে কেরামত আলীকে দেখা গেল হঠাৎ। এলাকায় বেশ প্রভাবশালী ব্যক্তি। জামায়তে ইসলামী করে। সে তো পাকিস্তানের পক্ষের লোক। শেখ মুজিবকে পাগল, দেশদ্রোহী আরও কত কিছু যে বলে বেড়ায় এ। এলাকার লোক জন তাকে খুব একটা সুনজরে দেখেনা। গৃহযুদ্ধ শুরু হবার পর এখানকার পরিত্যক্ত ডাকঘরটাকে কেরামত আলী আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা মিলে রাজাকারদের অফিস বানিয়ে নিয়েছে। তাতে স্থান করে নিয়েছে কায়দে আজমের বিরাট ফ্রেমে বাধাই করা এক ছবি আর ছাদে উড়ছে বিশাল এক পাকিস্তানি পতাকা। কেরামতদের প্রায় এখানে “পাকিস্তান জিন্দাবাদ” বলে চিৎকার করতে শোনা যায়। সেই কেরামত আলী এখন ফকরুলের ঘরের সীমানায় এক হাতে আম গাছ ধরে রয়েছে। আরেকহাতে মাথার টুপিটা খুলে একবার ঝেড়ে নিয়ে আবার মাথায় চালান করে নেয়। তার সামনে কেউ একজন পেছন ফিরে দাঁড়ানো। খুব গভীর কিছু আলোচনা হচ্ছে দুজনের মধ্যে বুঝা যাচ্ছে বেশ। মাথায় রক্ত চড়ে যায় ফকরুলের। তার আঙিনায় রাজাকার দাঁড়িয়ে। কি অসহ্য! অনেকক্ষণ কথা বলার পরে সেই সামনে থাকা লোকটি এবার এপাশে ফিরল। এবার তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। লোকটি আর কেউ না ফকরুলের ছোট ছেলে কাজল।
কেরামত আর কাজল কোলাকুলি করে নেয়। কেরামত আড়চোখে একবার বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে। এরপর মাঠ পেরিয়ে সোজা হাঁটা দেয়। যাবার সময় মাঠের ভাঙা প্রাচীর্রের গায়ে একটু আগে লাগানো ইয়াহিয়ার ঐ বিকৃত পোস্টার ক্রুদ্ধ হয়ে দেওয়ালের গা থেকে ছিঁড়ে সামনে ছুঁড়ে মেরে ফেলে দেয়।
ফকরুলের বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে। কলিজাটাও যেন কেঁপে যায়। কাজল! ও কি করছে কেরামতের সাথে? কি এত কথা এই দুজনের মাঝে? ওদের কথা শেষ হয় একসময়ে। যাবার সময় কেরামত আর কাজল কোলাকুলি করে নেয়। কেরামত আড়চোখে একবার বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে। এরপর মাঠ পেরিয়ে সোজা হাঁটা দেয়। যাবার সময় মাঠের ভাঙা প্রাচীর্রের গায়ে একটু আগে লাগানো ইয়াহিয়ার ঐ বিকৃত পোস্টার ক্রুদ্ধ হয়ে দেওয়ালের গা থেকে ছিঁড়ে সামনে ছুঁড়ে মেরে ফেলে দেয়। কাজলকে দেখা গেল কেরামতকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে। মানে কি এসবের? ফকরুল হতবাক হয়ে যায়। কাজল গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ফকরুল জিজ্ঞেসা করে, “ঐ কেরামতের সাথে এত কি কথা তোর?” কাজল কোন উত্তর করে না। একহাতে দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে ঘরের ভেতর চলে যায়। ফকরুল সাহেব দাঁড়িয়ে রইলেন একা। উনি চরম হতভম্ব। চরম হতভম্ব।
সেদিন সন্ধ্যার সময় ফকরুল সাহেব বাড়ির বসার ঘরে রেডিওর নব ঘোরাচ্ছেন। আকাশবাণী কলকাতা ধরা গেল। বাংলা সংবাদ শুরু হচ্ছে তখন
“ …বাংলাদেশের সকল জেলা মহকুমা শহরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ছড়িয়ে পড়েছে। নির্বিচারে নিরীহ মানুষকে হত্যা করছে আর অসহায় নারীদের ধরে এনে শারীরিক নির্যাতন করা হচ্ছে। বাড়ি ঘর সব জ্বালিয়ে দিচ্ছে। এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছেন…”
খবর চলতে থাকার মাঝ পথেই হঠাৎ কাজল ঘর থেকে ঝড়ের মত বেড়িয়ে যায়। ফকরুল সাহেব ওর চলে যাওয়া পথের দিকে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। বুকের মাঝের সেই হৃদকম্পনটা টের পান আবারও।
(চলবে)
আারও পড়ুন:
মায়ের গয়নার বাক্স, পর্ব–১
মায়ের গয়নার বাক্স, পর্ব–২
মায়ের গয়নার বাক্স, পর্ব–৩
মায়ের গয়নার বাক্স, পর্ব-৪
মায়ের গয়নার বাক্স, পর্ব–৫
মায়ের গয়নার বাক্স, পর্ব-৬