মায়ের গয়নার বাক্স, পর্ব–১

জন্মের পর থেকে যখন আয়ানের বুঝ–জ্ঞান হয়েছে তখন থেকেই সে দেখে আসছে তার মায়ের মাঝে কোনো বাড়তি শখ বলতে কিছু নেই। শখ বলতে যেমন ধরা যাক, নতুন শাড়ি–কাপড়, গয়নাগাটি, ঘর সাজানো গোছানো নাহ! এসবের কোনোটাই না। মায়ের স্বভাব চরিত্র কেমন যেন ঠাণ্ডা হিম শীতল। প্রয়োজন বা রুটিনের বাইরে কোনো কথা বা কাজ করতে মা কে অত্যন্ত কমই দেখে সে। সন্তানকে নিয়ে সব মায়েদের মাঝে যে আবেগের একটা বাড়াবাড়ি বা আধিক্য বেশকম থাকে সেটা ওর মায়ের মধ্যে ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। আয়ানের কখনও মনে হয় না মায়ের কোলে শুয়ে খোলা জানালার ওপারের আকাশের বুকে জ্বলে থাকা জ্বলজ্বলে তারার জ্বলে ওঠার কাহিনি শোনার কোনো মুহুর্ত। স্কুল ছুটির পর বাসায় ফিরতে একটু সময়ের এদিক ওদিক হলেও মায়ের মুখে তার জন্য কোনো রকম অস্থিরতা সে কোনো দিন দেখতে পায়নি। সব বিষয় সব পরিস্থিতি যেন স্বাভাবিক বড়। জগতে অস্বাভাবিকতা বলে যে একটা বিষয় আছে তা মায়ের জীবন খাতাতে যেন অদৃশ্য কোন এক অধ্যায়। তবে আয়ানের ধারণা মায়ের সবটাই যেন অস্বাভাবিকতায় ভরা।
আশ্চর্যের ব্যাপার, আয়ানের পড়া–লেখার ব্যাপারটাও মায়ের কাছে এত গুরুত্ব পেতো না। কোনো বিষয়ে কম মার্কস পেলে কখনও বকুনি খাওয়ার ভয় ছিল না আয়ানের। বন্ধু মহলে ও তাই একটু ঈর্ষার পাত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। সময় এভাবেই যাচ্ছিল। মায়ের এই গা ছাড়া ভাবটাই আয়ানের সয়ে গিয়েছে খুব। ব্যাপারটা সে উপভোগ করলেও মাঝে মাঝে একটু মনের মাঝে অস্বস্তির উদ্রেক হয়। মাঝে মাঝে ক্ষীণ সন্দেহ জাগে মনে। মায়ের মনে কি আসলে আয়ানের জন্য কোন জায়গা আদৌ আছে, কি নেই?
তবে প্রায় আয়ানের নজরে একটা জিনিস চোখে পড়ে। মা রোজ দুপুর বেলায় ওনার ঘরের দরজা লাগিয়ে বেশ কিছু সময় পার করেন। যখন দরজা খুলে বের হন, তার চোখে মুখে অদ্ভুত এক পরিবর্তন থাকে। চোখ দেখে সহজেই বুঝা যায়, উনি বেশ কান্নাকাটি করেছেন। মায়ের ব্যক্তিত্বের সাথে ঐ সময়কার চেহারাটা একেবারেই ভিন্ন, বেমানান এবং অদ্ভুত আশ্চর্যজনক। বিষয়টা আয়ানের কাছে বোধগম্য হয় না। মনের মাঝে নানা প্রশ্ন জাগে ওর! কী আছে ভেতরে? কেন মা প্রতিদুপুরে ঐ ঘরের দরজায় খিল দেন? কেনই বা চোখের পানি ফেলেন? মায়ের ঐ চেহারা আয়ানের মনে এক নিপীড়নেরই জন্ম দেয়। কিন্তু মাকে জিজ্ঞেসা করার সাহস তার হয় না। কী করে করবে ও? মা যে তার চারপাশে এমন এক কাঠিণ্যের দুর্ভেদ্য প্রাচীর তুলে রেখেছেন যার ভেতরে প্রবেশ করার সাহস আয়ানের নেই। মনের মাঝে প্রশ্নের দোলাচলটা ঘড়ির পেন্ডুলামের মত টিকটিক করে চলতে থাকে আয়ানের। মায়ের ব্যক্তিত্বের কাঠিণ্য, কাক ডাকা ঝাঁঝাঁলো দুপুর বেলা আর ঐ বন্ধ ঘরের দরজার রহস্যের কুপ ওঁকে অস্থির করে তোলে। নিষিদ্ধ জিনিষের প্রতি আকর্ষণ মানব মনের এক সহজাত প্রবৃত্তি। আয়ানেরও মায়ের ঢেকে রাখা সেই রহস্যের ওপর ক্রমেই আগ্রহের মেঘ পঞ্জীভূত হতে থাকে।
[চলবে]
সোনিয়া তাসনিম খান : কথাসাহিত্যিক
2 thoughts on “মায়ের গয়নার বাক্স, পর্ব–১”