সাদাসিধে পরিতৃপ্তির জীবন

ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত একজন মানুষ বসে আছেন ক্লাসের এক্কেবারে সামনে ওব্লাক বোর্ডের কাছাকাছি চেয়ার খানায়। দুইহাত দুইপাশের হাতলে (হ্যান্ড রেস্ট) রেখে হেলান দিয়ে বসার সুব্যবস্থা রয়েছে সেই চেয়ারটিতে। টেবিলের নিচে প্রস্থ বরাবর রয়েছে দুটো কাঠের দণ্ড আর সেই কাঠ দুটির উপর সমকোণে এবং টেবিলের দৈর্ঘ্য বরাবর রয়েছে একখানা পাদানি (ফুট রেস্ট)। সেই পাদানিতে দুই পা রেখে ডানে-বামে অনবরত দুলিয়ে যাচ্ছেন, সেই সাদাআলোর মানুষটি। পাদানির ঠিক নিচেই অবস্থান করছে এক জোড়া নীল রঙের ফিতাসহ স্যান্ডেল। ক্লাসে কোনো শব্দ নেই, পা দুখানা দুলেই যাচ্ছে সরল দোলকের মতো। চারদিকে নিশ্চুপ নীরবতা!
কিছুক্ষণের মধ্যে ছাত্রছাত্রীদের স্যান্ডেল নাড়াচড়ার হিস হিস শব্দ শোনা যাচ্ছে, ধীরে ধীরে ক্লাসের সেই নিস্থব্ধতাটুকুও কমে আসছে। স্যারের পা দোলানো কমছে না। কেউ কিছু বলছে না, ক্লাসের দুষ্ট ছেলেরা ধীরে ধীরে তাদের উপস্থিতি জানান দেয়া শুরু করতে চাচ্ছে কিন্তু চারদিকের এই গুমোট আবহাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে তাদের সঞ্চয়ে থাকা সাহস। হুট করে একজন জিজ্ঞাসা করে ফেললো ‘স্যার আপনার স্যান্ডেল জোড়া খুব সুন্দর’। প্রতিউত্তরে স্যার বললেন ‘হ্যাঁ, রূপসা স্যান্ডেল, খুবই আরাম’।

শুরু হয়ে গেলো আজকের ইংরেজি ক্লাস। সবাইকে একে একে ইংরেজি বইয়ের গল্পগুলোকে রিডিং পড়ে শোনানোর জন্য বললেন। একজনের পরএকজন পড়ছে, কিন্তু কেউ কেউ খুব বেশি পড়ার সুযোগ পাচ্ছে না। যারা ভালো উচ্চারণে পড়তে পারছে, তারা মাত্র কয়েক লাইন পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। আর যাদের উচ্চারণ কিছুটা দুর্বল এবং সময় নিয়ে উচ্চারণ করছে, তাদেরকে পড়তে হচ্ছে পুরো প্যাড়া। ইংরেজি শব্দের উচ্চারণে ভুল হলেই, স্যার শুদ্ধ উচ্চারণ শুনিয়ে দিচ্ছেন ক্লাসের সবাইকে। কঠিন শব্দগুলোর উচ্চারণ ভেঙে ভেঙে ব্যাখ্যা করতেন স্যার, আর বলতেন ‘কথাটা বুঝেছ কি না’।
ইংরেজি শব্দের উচ্চারণে ভুল হলেই, স্যার শুদ্ধ উচ্চারণ শুনিয়ে দিচ্ছেন ক্লাসের সবাইকে। কঠিন শব্দগুলোর উচ্চারণ ভেঙে ভেঙে ব্যাখ্যা করতেন স্যার, আর বলতেন ‘কথাটা বুঝেছ কি না’।
তখনকার সময়ে ইংরেজি শিক্ষকেরা ব্যাকরণ এবং উচ্চারণের বিষয়ে ছিলেন নিখুঁতভাবে সচেতন। কেউ তাদের কাছ থেকে একটি ভুল উচ্চারণের শব্দ শেখার সুযোগ পেত না। নিজের মাতৃভাষাকে অনেক ভুল-ভাল উচ্চারণেই বলা যায়, কারণ সে তো মায়ের ভাষা। কিন্তু অন্যের মাতৃভাষাকে ভুলভাবে উচ্চারণ করার অনুমতি তো নেই। হয়ত এ ধরণের কিছু কারণেই তারা ছিলেন ভীষণভাবে সচেতন। ইংরেজদের দেশে প্রায় নয় বছর থাকার পরেও ভুল-ভাল উচ্চারণে ইংরেজি প্রায়শই বলা হয়ে যায়। আর যাদের মাতৃভাষা ইংরেজি, তারা ইচ্ছেমতো বিভিন্ন উচ্চারণে ইংরেজি বলে। বলবেই তো, এটা তো তাদের মাতৃভাষা, মায়ের কাছে আবার দোষ কিসের?
করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার এক মাস আগে বাংলাদেশ ঘুরে আসার সুযোগ হয়েছিল। আমার লিখা বই দুইখানা তখনও ছাপাখানায় যাওয়ার সুযোগ পায়নি। তাই নিজের কাছে থাকা পাণ্ডুলিপি প্রিন্ট করে স্যারকে দেয়ার জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম। স্যার খুবই বাহবা দিলেন। তীরনই নদী নিয়ে একটি গল্প স্যারকে পড়ে শোনানোর সময় হিমালয়ের গঙ্গোত্রী নামক হিমবাহের কথাটি আসতেই, উনি বলে উঠলেন ‘গঙ্গোত্রী নিয়ে আমিও একটি কবিতা লিখেছিলাম’। ঠিক পরক্ষণেই হয়ত তার নিজের ফেলে আসা আরও অনেক সৃষ্টির কথা মনে পড়ল। ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে একখানা পুরোনো ডায়েরি বের করে তার নিজ হাতে লিখা কয়েকখানা কবিতা আবৃত্তি করে শোনালেন। পাশাপাশি বললেন প্রতিটি কবিতা লেখার প্রেক্ষাপট ও সময়কাল। কিছুক্ষণের জন্য উনি ফিরে গিয়েছিলেন ষাট বছর আগের কারমাইকেল কলেজের সেই তারুণ্যময় দুরন্ত কিন্তু ভীষণভাবে রোম্যান্টিক অতীতে। মনে হচ্ছিল, এ যেন এক ‘সময় ভ্রমণ’।

দারুণ কবিতা লিখেন স্যার এবং শুনেছি উনি নাকি ইংরেজিতেও কবিতা লিখতেন। ভিনদেশির ভাষায় কবিতা লিখা কী চাট্টি খানি কথা! প্রিন্ট করা সেই পাণ্ডুলিপি দুটো স্যারকে দিয়ে বলেছিলাম, ‘একজন ছাত্রের বই পড়ে আপনার কেমন লাগল, সেটার খোঁজ নেয়ার জন্য আমি আবার আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসব’। অবশ্য পরবর্তীতে তার নাতির মাধ্যমে একটি কারেকশন উনি পাঠিয়েছিলেন। বলেছিলেন ‘চায়না ফনিক্স’ বানানটি ‘চায়না ফিনিক্স’ হবে। স্যারের নির্দেশ মোতাবেক বানানটি ঠিক করা হয়েছিল। যখনই ‘চায়না ফিনিক্স’ সাইকেলের কথা মনে পড়ে, তখনই মনে হয় হাজার হাজার বার ভুল উচ্চারণ ও বানানে জপেছি এই শব্দগুচ্ছ। শিক্ষকেরা কখনই অবসর গ্রহণ করেন না, অবসর নেয়ার পেশা তো এটি নয়!
ত্রিশ বছর আগে রুহিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে মেয়েদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। কারণ তখনও মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার হার এখনকার মতো এত ছিল না। তা ছাড়া সমসাময়িক সময়ে রুহিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (মজিদা খাতুন বালিকা বিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়, এলাকার বেশিরভাগ মেয়েই বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ত। কেবল গুটিকয়েক সাহসী বাবাদের দুঃসাহসী মেয়েরাই রুহিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তেন। ছেলে ভরা স্কুলে হাতে গোনা কিছু মেয়ে। স্কুলের পিটিতে ছেলেদের থাকতো ৬-১০ টি লম্বা লম্বা লাইন, আর মেয়েদের থাকত একটি ছোট্ট লাইন।
সঙ্গত কারণেই ক্লাসে নগণ্য সংখ্যায় ছাত্রী থাকত। মেয়েদের বসার জন্য একটি বেঞ্চই যথেষ্ট ছিল। মেয়েদের বেঞ্চ থাকত শিক্ষকগণের হাতের বাম পাশে, কারণ বেশিরভাগ শ্রেণি কক্ষের দরজা ছিল বসে থাকা স্যারদের হাতের ডান পাশে। একবার এক বন্ধু মেয়েদের বেঞ্চের দিকে স্যান্ডেল ঠেলে দিতেই স্যার বিষয়টি টের পেয়ে সেই বন্ধুটিকে দাঁড়াতে বললেন। ছেলেটি দাঁড়াতেই স্যার বললেন ‘বেহা কঢ়িবো, বেহা? তোর বাপক মুই কাইলহে কহিম তোক বেহা দে দিবার তানে’।পরক্ষণেই আবার বললেন ‘তোমরা কিন্তু কেউ আবারও কে কিছু বলবে না’।
স্যার একটি কথা প্রায়শই বলতেন ‘কথাটি বুঝেছ কি না’। একবার কি যেন একটি বিষয় পড়াতে পড়াতে হঠাৎ বলে উঠলেন ‘কথাটি বুঝেছ কি না’। ক্লাসের দুষ্ট ছেলেটি বলল ‘কী কথা স্যার, বুঝিনি তো’। প্রতিউত্তরে স্যার বলেছিলেন ‘তোর মারঠে বুঝে লিস’। ক্লাসে একজন ‘তোষামোদ’ শব্দের অর্থ স্যারের কাছে জানতে চেয়েছিল। স্যার উত্তরে বলেছিলেন ‘হোল তোলথা’।
স্যার একটি কথা প্রায়শই বলতেন ‘কথাটি বুঝেছ কি না’। একবার কি যেন একটি বিষয় পড়াতে পড়াতে হঠাৎ বলে উঠলেন ‘কথাটি বুঝেছ কি না’। ক্লাসের দুষ্ট ছেলেটি বলল ‘কী কথা স্যার, বুঝিনি তো’। প্রতিউত্তরে স্যার বলেছিলেন ‘তোর মারঠে বুঝে লিস’। ক্লাসে একজন ‘তোষামোদ’ শব্দের অর্থ স্যারের কাছে জানতে চেয়েছিল। স্যার উত্তরে বলেছিলেন ‘হোল তোলথা’।
এভাবেই অনেক মজার মজার কথা উনি ক্লাসে বলতেন। স্যারের অনেক কথায় সংক্রামক হাসির উৎপত্তি হত। ত্রিশ বছর পরেও বন্ধুরা একসঙ্গে হলে এসব কথা আলাপচারিতায় চলে আসে আর উদ্রেক হয় এক স্বতঃস্ফূর্তআনন্দময় হাসির। আশ্চর্যের বিষয় হলো উনার কথায় ক্লাসের সকলে হাসলেও উনি কখনও নিজের কথায় হাসতেন না। একটি ক্লাসে প্রাণবন্ত পাঠদানের পাশাপাশি কীভাবে হাসি ঠাট্টা দিয়ে সকলকে ক্লাসের মধ্যখানে ধরে রাখা যায়, সেটা আমরা দেখেছি আমাদের সকলের প্রিয় ‘বদরুল ইসলাম’ স্যারের কাছ থেকে। এমন প্রতিভাধর শিক্ষক সত্যই বিরল!
স্যারকে স্কুলের বাইরে দেখার অনেক সুযোগ হয়েছিল। তবে বেশির ভাগ সময়েই উনি যখন সাইকেল চালিয়ে যেতেন। মজার বিষয় হলো উনি লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় সাইকেল চালাতেন এবং উনার সাইকেলের বেলের পাশে একটি পাটের ব্যাগ থাকতো, সম্ভবত সেই ব্যাগটিতে চেইন ছিলো। এক বন্ধু এই বিষয়টি খেয়াল করেছিলেন। তার পর্যবেক্ষণের ফলাফল ছিল কিছুটা এ রকম: স্যার ব্যাগের ভেতরে পায়জামা নিয়ে আসতেন। আর স্কুলে এসে লুঙ্গি পরিবর্তন করে সেই পায়জামা পরিধান করতেন। যতটুকু মনে পরে উনি পান খেতেন কিন্তু কখোনই তার সাদা পাঞ্জাবী কিংবা পায়জামায় এক ফোটা পানের পিচকিরি দেখা যায় নি। উনি ভীষণভাবে পরিপাটি ও গোছানো একজন মানুষ।
এতো বড় মাপের মানুষ কিন্তু সাদাসিধে জীবনযাপন করেই উনি অভ্যস্থ। ছোটখাটো অনেক বিষয়েই উনি আনন্দপান। এই ধরুন, হাঁটতে হাঁটতে পাশের বাড়ির গৃহিণীকে উঠোনে মাছ ভাঁজতে দেখে বলবেন ‘একটা মাছ ভাঁজে দিস তো’। সেই ছোট্ট মাছটি খেয়েই দিতে পারেন এক পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর। স্যার এখন তার বৃদ্ধ শরীরে চিরসতেজ মন নিয়ে বসবাস করছেন রুহিয়া থানার কানি কশালগাঁও গ্রামে। এভাবেই উনি নীরবে নিভৃতে বিলিয়ে দিয়েছেন শিক্ষার আলো এবং হয়েছেন সকলের শিক্ষক। এক জীবনে আর কি চাই?