আমার শৈশবে দুর্গাপুজো

শৈশবের দুর্গাপুজোর প্রতিটি মুহূর্ত এখনও তাজা। বর্তমানে জাঁকজমকপূর্ণ পুজোর পাশে আমার ছোটবেলার পুজো বড়ই ম্যাড়মেড়ে। কিন্তু সেই সময়ের পুজো নির্মল আনন্দ আর বিশুদ্ধ আন্তরিকতায় ভরপুর ছিল। আমার দেশের বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার বর্ধিঞ্চু গ্রাম ধোড়াদহ। বাবার চাকরি সূত্রে আমরা বাইরে থাকতাম। ছোটবেলায় পুজোর ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া একপ্রকার অভ্যাসের মধ্যেই পড়ত। নীল আকাশে সাদা মেঘের ঢেউ, শিশির, শিউলি আর খড়ে নদীর পাড়জুড়ে কাশফুল জানান দিত মেয়ে আসছে বাপের বাড়ি। কাশফুলমাখা শরতের ভোরের শিরশিরানির মধ্যে গায়ে কাপড়ের খুঁট জড়িয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে খঞ্জনি বাজিয়ে ঊষাকীর্তন করতে যাওয়া গানের দাদুর সেই ‘যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী উমা নাকি বড় কেঁদেছে’ শোনামাত্র পাড়ার স্বল্পবাস ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বাঁশবাগানের মধ্য দিয়ে ছুট লাগাতাম চৌধুরী পাড়ার বুড়ো বটতলার দিকে। আমাদের সঙ্গ নিত মুসলিম পাড়ার রায়ান, একিনরা। গানের দাদু এগিয়ে চলেছে, পেছনে সেই ছোটদের দল। ভরা খালের ওপর বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে চৌধুরী পাড়ার চণ্ডীমণ্ডপের আটচালার সামনে এসে দলটা দাঁড়াত। পাল পাড়ার মৃণাল কাকা এক মনে মাটি লেপছে মা দুর্গার গায়ে। গানের দাদু খানিক দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলে নমস্কার করে পদ্মপুকুরের পাশ দিয়ে এগিয়ে যেত। আমাদের গতিপথের সীমারেখা নির্দিষ্ট ছিল। তাই আর দাদুর পিছু নিতাম না। প্রতিমা কিভাবে দেবী হয়ে ওঠে দাঁড়িয়ে সকলে একমনে দেখতে থাকতাম। এরকমই এক সকালে রায়ান বলে ওঠে, এবারে অসুর খুব পালোয়ান। রায়ানের শীর্ণকায় চেহারার দিকে ইঙ্গিত করে পালকাকার গম্ভীর মন্তব্য, ঠিক তোর মতো। আমরা সবাই হো হো করে হেসে লুটোপুটি।

বাঙালির দুর্গাপুজো যতটা না ধর্মীয় উৎসব, তারচেয়ে অনেক বেশি সামাজিক উৎসব। এই পুজো হিন্দু-মুসলিম, ধনী-দরিদ্র সবার কাছেই সমান আনন্দের। তখন গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। বিশেষ করে এই ভাদ্র-আশ্বিনে। খেটে খাওয়া দিনমজুর পরিবারের ক্ষমতা ছিল না ছেলেমেয়েদের বছরে একবারের বেশি নতুন জামাকাপড় কিনে দেওয়ার। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব পরিবারের ছেলেমেয়েদের দুর্গাপুজোর সময়ই শুধু নতুন জামা হত। শুধু আমাদের গ্রামে নয়, আশপাশের সব গ্রামেই হিন্দু-মুসলিম সবার বাড়িতেই মেয়ে-জামাই, আত্মীয়স্বজন আসবে বলে ঘরদোর পরিষ্কার করা, বিভিন্ন স্বাদের নাড়ু তৈরি করা, ধার-উধার করে হলেও তাদের আদর আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে রাখা, পুজোর আগেই এই প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত। চারিদেকে পুজো পুজো গন্ধ আর সাজো সাজো রব।
আমাদের গ্রামের চৌধুরী বাড়ির বুড়িমার পুজো পাঁচশো বছরের পুরানো। দুর্গা দালান আজও এই অঞ্চলের মানুষের আবেগ, আন্তরিকতা, ভালোবাসা ও নিষ্ঠার পূর্ণ প্রতীক। ঠাকুর দালানে জন্মাষ্টমীর পুজোর সাথে সাথে মাতৃ প্রতিমার কাঠামো পুজো করে ঠাকুর বানানোর কাজ শুরু করা হত। একটা একটা করে দিন চলে যায়, প্রথমে বিচুলি দিয়ে কাঠামো, তারপর মাটির প্রলেপ, তারপরে রঙের ছোঁয়া। সেই রঙের ছোঁয়ায় গ্রামের মানুষদের মনও রাঙিয়ে উঠত।

বাঁশ ঝাড় থেকে রহমান চাচা, ফকির দাদুরা বাঁশ কেটে নিয়ে এসে ঠাকুর দালানের সামনে বিরাট সামিয়ানা টাঙাতেন। সপ্তমীর দিন নদীতে কলাবউ স্নান করাতে যাওয়ার সময় ঢাকির পেছনে আমরা ছোটরাও যেতাম। মহিলারা নতুন শাড়ি-গয়না পরে অষ্টমীর দিন অঞ্জলি দিতে চলেছেন। প্রতিদিন স্নান করে একসাথে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া, মহাষ্টমীতে একশো আটটা প্রদীপের সলতে পাকিয়ে প্রদীপ জ্বালানো, ঠাকুর দালানে পাত পেড়ে ভোগ খাওয়া, দশমীতে পান্তা ভোগ, আজ সবই অতীত। পুজো কাটত একটা বা দুটো জামা সম্বল করে, ক্যাপ ফাটিয়ে, লুকোচুরি খেলে। সেই সঙ্গে ছিল দাদু-ঠাকুমা ও কাকাতো ভাইবোনদের সাথে হৈ হুল্লোড়। পুজোর প্রসাদের নারকেলের নাড়ু পকেটে রেখে দিতাম রায়ানের জন্য। নাড়ু ছিল রায়ানের খুব প্রিয়। মুঠোসমেত নাড়ু কপালে ঠেকিয়ে রায়ান মুখের ভেতর খপাৎ করে চালান করে দিত। কী নির্ভেজাল আনন্দমাখা ছিল সেই দিনগুলো! উৎসবের মূল সুরের মূর্চ্ছনায় হিন্দু-মুসলমান একাকার হয়ে যেত। অদ্ভুত এক সম্প্রীতির বাতাবরণ বিরাজ করত গোটা গ্রামে।

আমাদের শৈশব-কৈশোরে, মানে আশির দশকে দুর্গাপুজো ছিল অফুরান আনন্দের উৎস। রথের মেলার পর থেকেই মায়ের খালি পণ্ডস পাউডারের কৌটো ফুটো করে পয়সা জমাতে শুরু করতাম পুজোর সময় মেলা দেখার জন্য। যেটুকু পয়সা সঞ্চয় করে রাখতে পারতাম তাই দিয়েই কাটত পুজোর চারদিনের আনন্দ। কৌটো ভাঙা পয়সা সম্বল করে ছোট ভাই বোনদের সাথে ঠাকুর দেখতে যাওয়া, বেলুন কেনা, মেলায় ঘুগনি, পাপড় ভাজা খাওয়া, আজ সবই নস্টালজিক অনুভূতি। সপ্তমী থেকে দশমী মেলা বসত। মেলায় নাগরদোলা আসত। রাতে পুতুল নাচের আসর বসত। ছোট বেলায় পুতুল নাচের নানা বিচিত্র পৌরাণিক গল্পকথা আমার কাছে খুবই আকর্ষণীয় ছিল। পাশেই হ্যাজাক জ্বেলে আটচালায় হত যাত্রাপালা। এই যাত্রাপালাই ছিল ছেলে-বুড়ো সবার কাছে দুর্গাপুজোর মূল আকর্ষণ। আমরা মিউজিসিয়ানদের ঠিক পিছনে বসতাম। গ্রামের মানুষেরাই অভিনয় করতেন। রোজ সন্ধেবেলা কাছারি বাড়িতে যাত্রার মহড়া চলত।

কী সুন্দর ছিল শারদীয়ার দিনগুলো। আজও মন উতলা হয়ে ওঠে সেই ঢাকের আওয়াজে, ধূপের সুগন্ধে। গোধূলি বেলায় পড়ন্ত সূর্যের আভায় খড়ে নদীর জলে মা দুর্গার নিরঞ্জনের শোভা বড়ই মনোরম ছিল। একই সঙ্গে বিসর্জনের বাজনায় মন খারাপ হয়ে যেত। আসছে বছর আবার হবে…..