একজন আলোর পথপ্রদর্শক

“শিক্ষক হলেন শ্রদ্ধার পাত্র শিক্ষার অতি সুজন শিক্ষকরাই করেন একেকজন উকিল, ডাক্তার সৃজন।”শিক্ষক হলেন মানুষ গড়ার কারিগর। একটি স্বপ্নময় সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার ক্ষেত্রে একজন আদর্শ শিক্ষকের ভূমিকা থাকে সর্বাগ্রে। কালের যাত্রার ধ্বনি অনুরণিত ওয়ে ওঠে শিক্ষকের কণ্ঠে। জ্ঞানের রাজ্যে আমাদের পদচারণার শুভ উদ্বোধন ঘটে শিক্ষকের পুণ্য করম্পর্শে, অবাধ বিচরণ চলে তাদের ক্রমাগত দিক নির্দেশনায়। জীবন সুগঠনের মন্ত্র পাই তাদের বাণী থেকে।
তারা সংখ্যায় অনেক কিন্তু স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল। তারা বৈচিত্রে ভিন্নতর, কিন্তু আকর্ষণে অনন্য। তবু তাদের আলোর মিছিল থেকে প্রিয় শিক্ষক হিসেবে একজনকে পৃথক করাই যায়। আমার প্রিয় শিক্ষকের আদর্শ, চিন্তা-চেতনা, নির্দেশনা আমার পাথেও। তার জীবনবোধ ও প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করেই আমি আজ আলোর পথের যাত্রী। তার মহান সান্নিধ্য লাভ করতে পেরে সত্যি আমি নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করি।
“প্রাইমারি পাশ করেছি/
আমি এখন ক্লাস সিক্সে,
রুখবে আমায় কে?”
ছোট বেলায় বাড়ির ঠিক সামনে প্রাইমারী স্কুলের দেয়ালে কার্টুন চিত্রে এক উচ্ছ্বসিত কিশোরীর ছবিসংলগ্ন উপরোক্ত লেখাটি দেখতাম আর স্বপ্ন দেখতাম আমি কবে হাইস্কুলে যাবো। দেখতে দেখতে সত্যি সত্যি একদিন প্রাইমারি পাশ করে বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটারেরও বেশি দুরত্বে অবস্থিত রতিগ্রাম বি.এল হাইস্কুলে ভর্তি হই। মাধ্যমিক শিক্ষাজীবনের স্কুলে প্রথম দিনের প্রথম ক্লাসটিই ছিলো আমার প্রিয় শিক্ষকের। সেদিনই তার সাথে আমার প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়। যদিও তার সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় আরো অনেক পুরোনো। সে কাহিনি নাহয় লেখার শেষের দিকে উল্লেখ করবো। আপাতত রহস্যই থাক। প্রথম ক্লাসে যথারিতি পরিচয় পর্ব শেষে বিষয়ভিত্তিক সংক্ষিপ্ত পাঠ। তিনি আমাদের ইংরেজি পড়াবেন। একের পর এক ইংরেজি বেসিক সম্পর্কে সেদিনের তার আপ্তবাক্য উপস্থিত প্রত্যেকের মাঝেই মুগ্ধতা সৃষ্টি করেছে বলে আমার বিশ্বাস।
আমার প্রিয় শিক্ষকের নাম মো.নুর ইসলাম। শিক্ষাজীবনের ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম পুরো পাঁচটি বছর তাকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক হিসেবে পাবার সুযোগ হয়েছে আর পুরো জীবনের দিকনির্দেশক হিসেবে পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। তার ক্লাস নেবার নিত্যনতুন অভিনব কৌশল প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পড়াশোনায় মনযোগ ধরে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন “সৃষ্টিশীল প্রকাশ এবং জ্ঞানের মধ্যে আনন্দ জাগ্রত করা হলো শিক্ষকের সর্বপ্রধান শিল্প।” আর এই শিল্পগুণে সমৃদ্ধ ছিলেন আমাদের নুর ইসলাম স্যার। তার এই শিল্প জাদুর ছোয়ায় আমাদের অনেক জটিল এবং কঠিন পাঠগুলোও অত্যন্ত সহজেই আয়ত্ত করা সম্ভব হতো। বইয়ের জটিল বিষয়গুলোকে আনন্দের সাথে মগজে ঢুকিয়ে দেবার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তার।
স্যারের যে দিকটি সবথেকে বেশি আমায় আকর্ষণ করতো তা হলো সহপাঠ্যক্রমিক কাজ গুলোতে ব্যপক উৎসাহ প্রদান। “তুমি পারবে, তবে কথাগুলো আর একটু স্লো এবং স্পষ্ট করার চেষ্টা করো।” -তার মুখনিঃসৃত এই একটি বাক্যের জোরেই বোধহয় ২০১৪সালে ব্রাক কতৃক আয়োজিত বিতর্ক প্রতিযোগীতায় কুড়িগ্রাম জেলায় শ্রেষ্ঠ বিতার্কিক হবার গৌরব অর্জন করেছিলাম আমি। কিন্তু দলীও ভাবে হেরে যাওয়ায় যখন ভেতরে ভেতরে ক্ষোভে ফেটে পরছিলাম অন্যদিকে চোখের পানি টলমল তখন তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন “একজন আদর্শ বিতার্কিকের বৈশিষ্ট্য কী? বিতর্কের রায় মেনে নেওয়া। তাই নয় কি?” তারপর ধীরে ধীরে আপনাআপনি মন ভালো হয়ে যায়। তার এমন বাস্তবধর্মী অসংখ্য বাক্য বার বার যেমন আমায় সাফল্যের পথ দেখিয়েছে তেমনি শিখিয়েছে জীবনের জটিল এবং কঠিন বাস্তবতা গুলোতে কীভাবে হাসিমুখে মেনে নিতে হয়। দেয়াল পত্রিকা, খেলাধুলা সহ জাতীয় দিবসগুলোতে স্কুলের ব্যতিক্রমধর্মী সব আয়োজন গুলোর মধ্যমণি তিনি। তার উৎসাহেই এমন আয়োজন গুলোতে আমার এবং আমাদের সম্পৃক্ততা। শুধু পড়াশোনা নয়, একজন শিক্ষার্থীর মানসিক উৎকর্ষ সাধন এবং সত্যিকারের মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপই যেন তার জানা। প্রতিটি বিষয়েই তার নিষ্ঠা, সময়ানুবর্তিতা এবং নিয়মানুবর্তিতা সবসময়ই আমাকে অনুপ্রাণিত করে।
ছুটির ঘন্টা বেজে গিয়েছে। সবাই ছুটোছুটি করে স্কুল থেকে বেরিয়ে গিয়েছে প্রায়। স্যার সেদিন নিজের সাইকেলটি নিয়ে বের হবে এমন সময় বিমর্ষ রূপে তার সামনে দশম শ্রেণীর একজন ছাত্রী। মেয়েটি তাকে কিছু বলতে চায় ব্যাপারটি বুঝতে পেরে তিনি নিজেই মেয়েটির খবরাখবর চানতে চান। কিছু কথা বলে পরিস্থিতি সহজ করে নিলে মেয়েটি তার বিমর্ষতার কারন জানায়। তিনি সবটা শুনে ছাত্রীটিকে অভয় দিয়ে বাড়ি চলে যেতে বলেন। সেদিন তার একটি নিরব পদক্ষেপে বাল্যবিবাহ থেকে বেঁচে যায় সম্ভাবনাময়ী একটি মেয়ে। যতদূর জানি, সেদিনের সেই মেয়েটি আজ ছোট্ট হলেও সমাজে একটা অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। তিনি নিজে কখনো এ গল্প কারোর কাছে করেছেন বলে মনেহয় না। তবে খুব কাছের একজনের কাছেই ঘটনাটা জেনেছি আমি। তারপ্রতি বরাবরের শ্রদ্ধাবোধ যেন আরো উচ্চতায় আসীন হয়েছে। শুরুতেই বলেছি ষষ্ঠ শ্রেণীর প্রথমদিন তার সাথে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় হলেও ব্যক্তিগতভাবে তার সাথে পরিচয় বহু পুরোনো। এবার নাহয় সেই রহস্যের অবসান ঘটুক। তিনি শুধু আমার একাডেমিক শিক্ষকই নন তিনি আমার জন্মদাতা পিতা। কিন্তু এ রচনায় বাবা-মেয়ের ব্যক্তিগত সম্পর্কের বাইরে গিয়ে শুধুমাত্র একজন সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে আমার বক্তব্য তুলে ধরবার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি।
প্রতিবছর ৫ অক্টোবর “বিশ্ব শিক্ষক দিবস” হিসেবে পালন করা হয়। এ দিনটির আমার কাছে আলাদা বিশেষত্ব রয়েছে। কারন দিনটি শুধু “বিশ্ব শিক্ষক দিবস” নয়, আমার প্রিয় শিক্ষাগুরুর জন্মদিনও। দিনটি বারবার তার জীবনে ফিরে আসুক। তার সুস্বাস্থ্য এবং দীর্ঘায়ু কামনা করছি। “আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবস” -এর সফলতা কামনা করছি একই সাথে আমার প্রিয় শিক্ষক, পথপ্রদর্শক সহ শিক্ষা জীবনের প্রত্যেক শিক্ষক এবং শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় নিয়োজিত সকলের প্রতি শ্রদ্ধা, সালাম এবং শুভকামনা।
~মোছা. নুসরাত জাহান শিক্ষার্থী, অনার্স ৩য় বর্ষ (ইংরেজি বিভাগ)কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজকলেজ পাড়া (তালতলা), কুড়িগ্রাম মেইল: nusrat9875jahan@gmail.com