বুদ্ধদেব গুহ স্মরণে: ইতি লালাদা

দিনটা আগস্ট ৩০, আকাশের মুখ ভার, এ যেন প্যাথেটিক ফ্যালেসি ।অবিরাম ঝিমঝিম বৃষ্টি,আকাশদুহিতার চোখের জল অবিরল,অবিরাম ।মন ভালো নেই কারোর ,সংবাদপত্রের সন্ধানী ক্যামেরা থেকে অভিজাতর মঁ ব্লাঁ ,কিশোরীর ঘুঙুর থেকে যুবতীর হরিণরঙা অন্তর্বাস ।সবার মনখারাপ কারণ মন ভালো করার বিষণ্ন জাদুকর ফেলে রেখে গেছেন তাঁর ম্যাজিক ওয়ান্ড।সানি টাওয়ার্সের সব মায়া, সব ছায়া আজ অপসৃয়মান। ভীড় তখন সানি টাওয়ার্সের নীচে। কে নেই? দুঁদে রাজনীতিবিদ থেকে প্রকাশক ,অবশ্য হিমাদ্রীকিশোর ছাড়া আর কোনো লেখককে দেখা যাচ্ছিল না।অবিরল ফুলের জলসায় নীরব তখন সাহেব। সময়ের সময় থাকে না সময় নষ্ট করার, সময় তাঁকে নিয়ে গেল মহাশ্মশানে।চিতা বহ্নিমান ।ধোঁয়ার জাল আকাশকে ফাঁদে ফেলতে উদ্যত,মন হতোদ্যম, হঠাৎই চিতার মধ্যে থেকে উড়ে এলো একটা চিঠি।চিঠিতে লেখা—
প্রিয় পাঠক,
তুমি কি কাঁদছ? কাঁদো।মানুষই কাঁদে,শয়তান তো কাঁদে না, শয়তানের চোখ জ্বলে লোভাতুর ভাবে ।শয়তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়নি তাই কোনোদিন।আভিজাত্যের নামাবলীর নিচে অনেক কান্না ছিল আমারও। বড় লোকের কান্না থাকে না বুঝি? সেসব কান্না চামচ দিয়ে মেপেই তো মিশিয়েছি অক্ষরে।তাই তো আমার উপন্যাস অশ্রুজলের অভিধান।আর অভিমান? সমরেশ একবার বলেছিল ‘সাহেব বড় অভিমানী’। হ্যাঁ অভিমান সর্বস্ব মানুষ আমি। ধনেশ পাখির মতো অভিমানী আমি, ধনেশ পাখির অভিমান হলে সে অভিমানে পাখি ঝাপটানো বন্ধ করে দিয়ে শূন্যতায় আত্মহত্যা করে।সি এ পরিচয় বয়ে বেড়িয়েছি ,সফল হয়েছি ,শুধু মেলাতে পারিনি মুখ আর মুখোশের জটিল ক্যালকুলাস।তবু পাঠক আমি হেরে যাইনি বরং তোমাদের জন্য নিরন্তর হেঁটে গেছি ম্যাকলাস্কি থেকে গারো পাহাড়,চাঁদের আলোয় আলমোড়া থেকে আন্দামানের নির্জন আইল্যান্ড।
তুমি কি কাঁদছ? কাঁদো।মানুষই কাঁদে,শয়তান তো কাঁদে না, শয়তানের চোখ জ্বলে লোভাতুর ভাবে ।শয়তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়নি তাই কোনোদিন।আভিজাত্যের নামাবলীর নিচে অনেক কান্না ছিল আমারও। বড় লোকের কান্না থাকে না বুঝি?
কলকাতার যান্ত্রিকতা থেকে চলে গেছি মারোমার বন বাংলো অথবা অচানকমার। তোমাদের জন্য রেখে এসেছি বাঁচার রসদ,ওগো মানুষ ফেরো, ফেরো,অরণ্যের ছায়ায় ফেরো।এবার কান্না মোছো,মনে পড়ে লিখেছিলাম সাসানডিরিতে,মুন্ডাদের বিশ্বাসের কথা’নে জন্ম বারসিং নাগেন” এই শরীর পচে যায়, এই শরীর চলে যায় জ্বলে যায়, কিন্তু তাঁর আত্মা ,ওদের ভাষায় জী ,রোয়া ,থেকে যায়,যার মৃত্যু নেই। ভেবো একবার এ তো উপনিষদেরই ভাষ্য বা বিশ্বাস।এ কথাই বলতে চেয়েছি। কাঠের আগুনে আমার নশ্বর দেহ পুড়ছে অথচ আমি ক্লিষ্ট নই জানো? ক্লিষ্ট নই কারণ আমি তৃপ্ত জীবনকে চুমুকে চুমুকে পান করেছি।আগুনের পর্দা ভেদ করে আমি যাব অদৃশ্যলোকে।মনে আছে অবরোহী উপন্যাসের সেই কথাগুলো। সেই যে দেশের কথা বলেছিলাম যেখানে সুন্দরের ছবি ফোটে প্রতি সন্ধ্যায়, যেখানে ঈর্ষা নেই, কপটতা নেই পিছন থেকে ছুরি মারা নেই। শুধু অখণ্ড অবসর। যেখানে সুন্দরের ই ছবি ফোটে প্রতি সন্ধ্যায়। কত শব্দ কানে আসছে আমার, শেষ বয়সে যেসব শব্দ আমায় ছেড়ে গেছিল, যেসব দৃশ্য আমায় ছেড়ে গেছিল সব ফিরে ফিরে আসছে। তোমাদের তো শুনিয়েছি সেসব গান—
‘দোলাংহো পিরিওসুরি হুন্দিবা
দোলাংহো শুশুমকোতেলা
দোলাংহো ইচাচিংড়িচম্পায়েরা
দোলাংহো কারামেকোতেলাং”

ঐ তো দূরে চাঁদুবাবু, গোপাল, শামীম মিঞা।সকালবেলার শিশিরের মতো স্পষ্ট।ঐ যে দু’পাশে চষা জমি।মাঝে মাঝে দু একটা গাছ। সামনেই মান্দার ।পথের পাশে হাট বসেছে । ওঁরাও ছেলেমেয়েরা ভীড় করেছে। একটি কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে একটি ওঁরাও মেয়ে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে রয়েছে।একটি ছেলে মোষের পিঠে চড়ে হাটে এসেছে ।কী যেন বলছে ছেলেটি মেয়েটিকে ।মোষটা একবার মাথা ঝাঁকাল।ছেলেটি বলছে কানে কানে মেয়েটিকে—
‘হালফিলের মেয়েরা
প্রজাপতির মতো নরম
ইসস হাত ছুঁইয়ে দেখো
প্রজাপতির মতো নরম”
এবার অচানককমার থেকে বিড়িগড়, করবেট থেকে পেঞ্চ, মারোমার থেকে রাজডেরোয়া হেঁটে হেঁটে ঘুরব সব।মাধুকরীতে লিখেছিলাম না এই জীবনে মাধুকরী করতে করতেই বাঁচা, বড় পরনির্ভর হয়ে বাঁচা সে যে।বেঁচে থেকে মানুষ বড় বাঘের মতো বাঁচতে পারে না। যে কথা লিখে যেতে পারিনি তা চিতার অক্ষরে লিখলাম তোমরা একটু সরে এসো দেখতে পাচ্ছ?
এবার অচানককমার থেকে বিড়িগড়, করবেট থেকে পেঞ্চ, মারোমার থেকে রাজডেরোয়া হেঁটে হেঁটে ঘুরব সব।মাধুকরীতে লিখেছিলাম না এই জীবনে মাধুকরী করতে করতেই বাঁচা, বড় পরনির্ভর হয়ে বাঁচা সে যে।বেঁচে থেকে মানুষ বড় বাঘের মতো বাঁচতে পারে না। যে কথা লিখে যেতে পারিনি তা চিতার অক্ষরে লিখলাম তোমরা একটু সরে এসো দেখতে পাচ্ছ?
(আমরা চিতা কাঠের আগুনে দেখলাম আরণ্যক স্বরবর্ণ, সেখানে লেখা)
“মেরুদন্ডী মানুষ মরে গিয়েও বাঘের মতো বাঁচতে পারে”
(চিতার আগুন নিভে যাচ্ছে।সাদা মানুষের চিঠির অক্ষর অষ্পষ্ট হচ্ছে।কী একটা ফুটে উঠছে চিঠির গায়ে ,একটা বিপন্ন অনুরোধ কিন্তু তা আভিজাত্যের মোড়কে “আমি জগতেরো কাছে ঘৃণ্য হয়েছি তুমি যেন ঘৃণা কোরোনা”
ইতি লালাদা
আমরা স্থবির।আমাদের ফিরতে হবে অনেক দূরে।অথচ চলতে বড় লাগে, বড় লাগে।লাগারই কথা কারণ আসলে আজ আমরা প্রত্যেকেই পৃথু ঘোষ।
আরও পড়ুন:
বুদ্ধদেব গুহ স্মরণে: আপনিই তো আমাদের ভালোবাসতে শিখিয়েছেন, ভালোবাসা বানাতেও।
বুদ্ধদেব অরণ্য পেরিয়ে অজানা এক অভিযানে
অকৃত্রিম ভালোবাসা ছাড়া বোধহয় প্রকৃত সৃষ্টি সম্ভব নয়
যৎকিঞ্চিৎ বুদ্ধদেব গুহ
বুদ্ধদেব গুহ’র মৃত্যুতে দুই বাংলায় শোকের ছায়া
‘জগমগি’—সাহসিকার পূর্ণ আখ্যান
৩৩ দিন করোনার সঙ্গে লড়াইয়ে জয় করে আবারও হাসপাতালে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ