গ্রামের নাম চাঁন্দামারী, যেথা ইতিহাস-ঐতিহ্যের ছড়াছড়ি

চাঁন্দামারী, নামটা শুনলেই কেমন একটা মাছ মাছ আমেজ পাওয়া যায়। কোন অপরিচিত ব্যক্তিকে যখন বলা হয় যে গ্রামের নাম চাঁন্দামারী, নামটা শুনেই ঐ ব্যক্তি বলে যায়গাটায় অনেক বেশি ছোট মাছ পাওয়া যায় নাকি? উত্তরটা হয় হ্যাঁ। মোঘল আমলে নির্মিত ঐতিহাসিক চাঁন্দামারী মসজিদ, ঐতিহ্যবাহী পদ্মফুল আর দেশি মাছ এ সবই চাঁন্দামারী নামক এই ছোট্ট গ্রামের ঐতিহ্য বহন করে আসছে।
উত্তরবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার রাজারহাট সদর ইউনিয়নে অবস্থিত একটি গ্রাম চাঁন্দামারী। আনুমানিক চার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ গ্রামে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের বাস। প্রায় সকল শ্রেণি-পেশার এবং বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষ সম্মিলিত ভাবে মিলেমিশে বাস করে এখানে। চাঁন্দামারী বাংলার অন্যসব গ্রামগুলোর মত হলেও আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রাচীন ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যবাহী নিদর্শনগুলো একে অনন্যতা দান করেছে।

গ্রামের প্রবেশদারেই কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আনুমানিক প্রায় পাঁচশত বছর পুরনো মোঘল আমলে নির্মিত ঐতিহাসিক চাঁন্দামারী মসজিদটি পরিচয় করিয়ে দেয় এখানকার ইতিহাসের সঙ্গে।
মসজিদটি ঠিক কত বছর পূর্বে নির্মিত এর কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও নির্মান শৈলীতে সুলতানি আমলের শিল্প বৈশিষ্ট্য ও মোগল স্থাপত্যকলার সমন্বয় লক্ষ্য করে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা ধারণা করেন এর নির্মাণকাল হবে আনুমানিক ১৫৮৪-১৬৮০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে।

মসজিদটি দৈর্ঘ্যে ৪০ ফুট এবং প্রস্থে ২০ ফুট। এটি সমতল টালি ইট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এবং এর নির্মাণকাজে ভিসকাস নামে এক ধরনের আঠালো পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছে। মসজিদের সামনের দিকে আনুমানিক সাড়ে চার ফুট তিনটি বড় দরজা রয়েছে। ওপরে তিনটি বড় গম্বুজ আছে যার ব্যাসার্ধ প্রায় ৫.৫০ফুট। গম্বুজ গুলোর গায়ে দৃষ্টিনন্দন নকশা করা আছে। চার কোণায় চারটি মাঝারি আকৃতির মিনার ও চারদিকে ঘিরে আছে আরও ষোলটি ছোট গম্বুজ। ভেতরের দিকে তিনটি মেহরাব আছে। মসজিদের গায়ে অনেকগুলো খিলান আছে। এ ছাড়া বায়ু চলাচলের জন্য উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একটি করে জানালা আছে। মসজিদটির সামনে একটি বড় পুকুর আছে।
তবে অবাক করার বিষয় যে এই মসজিদের ভেতরে ও বাইরে এখনও মুসুল্লিরা নিয়মিত নামাজ আদায় করেন। বর্তমানে স্থানীয় মুসল্লিদের নামাজের জন্য মসজিদের সামনে একটি টিন শেড ছাউনি প্রস্তুত করা আছে।

গ্রামের সেই আঁকাবাঁকা মেঠো পথ একেবারে হারিয়ে না গেলেও উন্নয়নের ছোঁয়ায় প্রধান সড়কগুলো এখন পাকা। মসজিদের পাশ দিয়ে সেই পিচঢালা পথ দিয়ে এগোতে থাকলে চোখে পড়বে একজোড়া স্কুল। বলা যায়, আমাদের উঠানেই এ স্কুলের অবস্থান। জ্ঞান হওয়ার পর সেই ছোট্ট বেলা থেকেই এ আঙ্গিনায় বিচরণ। ১৮৯৫ সালে তৎকালীন রাণী চৌধুরানী কতৃক প্রতিষ্ঠিত প্রাথমিক বিদ্যালয়টি সেসময় থেকে এ অঞ্চলের মানুষজনের শিক্ষা সংস্পর্শে থাকার প্রমাণ হয়ে দাড়িয়ে আছে। অপরদিকে একই আঙ্গিনায় অবস্থিত চাঁন্দামারী দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়টি স্বাধীনতা পরবর্তী বছরে অর্থাৎ ১৯৭২সালে স্থানীয় শিক্ষিত গণ্যমান্য ব্যক্তি কতৃক প্রতিষ্ঠিত হয়।

সেই ছোট্টবেলা থেকে এ বেলা এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুটির ঘণ্টার আওয়াজ শুনেই আমাদের বেড়ে ওঠা। প্রতিদিন লাইন করে জাতীয় সংগীত এবং পিটি-প্যারেড দেখতে আমরা অভ্যস্ত। যদিও করোনা মহামারী দীর্ঘদিন আমাদের এ দৃশ্য থেকে বঞ্চিত করছে। স্কুল শিক্ষার্থীদের নিত্য হৈচৈ আর সংলগ্ন বাজারে শোরগোল! অনেকের কমন প্রশ্ন, তোমরা থাক কিভাবে? আমরা যে চিরচেনা এই হৈচৈ এর সঙ্গেই অভ্যস্ত।
বিশাল এ স্কুল মাঠে নিয়ম করে প্রতিদিন খেলার আসর জমে ওঠে। তরুণ থেকে পৌঢ়, ফুটবল যেন এ গ্রামের মানুষজনের হৃদয়ে মিশে আছে। কেউ খেলে কেউ দেখে, এভাবে বিকেলটা কাটে। আমাদের ছেলেবেলায় বিকেলটা বৌছি, গোল্লাছুট কিংবা কানামাছি খেলায় মেতে থাকলেও সে দৃশ্য হারিয়ে যাবার পথে। তবে করোনা মহামারীর আর্শীবাদেই বলব ইদানীং সেই দৃশ্য কিছুটা হলেও চোখে পরে। হারিয়ে যাওয়া ঘুড়িও এখন নিত্য ওড়ে।

গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে চাকিরপশার নদী। অতীতে প্রবাহ থাকলেও বর্তমানে এটি বিলে পরিণত হয়েছে। গ্রামের পাশে নদীর অংশটি স্থানীয়দের কাছে চ্যাংমারীর দোলা নামে খ্যাত এবং আনুমানিক চার বর্গকিলোমিটার জুরে বিস্তৃত। আউষ মৌসুমে চাষিরা চাষ করলেও বর্ষাকালে পানির নিচে নিমজ্জিত থাকে এই ভূমি। যা শরৎকালে পদ্মফুলে ভরে ওঠে। যুগ যুগ ধরে প্রাকৃতিক ভাবে উৎপন্ন পদ্মফুল এই বিল এবং গ্রামটিকে অনন্যতা দান করেছে। অনেকেই দুর দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন পদ্মফুলে ছেয়ে যাওয়া এই বিলটির সৌন্দর্য অবলোকন করতে। এটাই সম্ভবত কুড়িগ্রাম জেলার সব থেকে বড় প্রাকৃতিক ভাবে উৎপন্ন পদ্ম সরোবর। প্রতি বছর শরৎ কালে লক্ষ লক্ষ পদ্মফুল ফোটে এই বিলে। ধান গাছের মত সারি সারি পদ্ম আর পদ্ম পাতা ভেসে থাকার কারণে কোথাও কোথাও বিলের জল-ই দেখতে পাওয়া যায় না। শুধু পদ্মই নয়, শাপলা-শালুকও ফোটে।

চাঁন্দামারীর এ বিলে (চ্যাংমারীর দোলায়) যুগ যুগ ধরে প্রাকৃতিক ভাবে নানান প্রজাতির দেশি মাছও উৎপন্ন হয়ে আসছে। অতীতে শীতকালে বিলটির পানি শুকিয়ে গেলে এখানে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখির সমাগম ঘটলেও ইদানিং তা অনেকটাই কমে গেছে।
বছরে এক মৌসুমে আউষের চাষ আর অন্য মৌসুমে পদ্মফুল আর মাছ। যা এই গ্রামের মানুষের প্রত্যাহিক জীবনের সঙ্গে নিভৃত ভাবে মিশে গেছে।

ধান, পাট, গম, ভূট্টা, আলুসহ নানা ধরনের ফসল জন্মে এ ভূমিতে। প্রতিটি গৃহস্থবাড়ীতে হাস-মুরগী, গরু-ছাগল পালন করা হয়। গৃহিণীরা বাড়ীর উঠনে নানা প্রকার সবজির চাষ করেন। এখানে প্রতিদিন বিকেলে হাট বসে। প্রায় সব পাড়ার লোকজন এ হাট থেকেই তাদের প্রয়োজনীয় বাজার-সদাই কেনা-বেচা করেন। অদূরেই অবস্থিত কমিউনিটি ক্লিনিকটির বিনামূল্যে প্রদানকৃত ঔষধসেবা এবং প্রাথমিক চিকিৎসা এখনকার মানুষের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় রাখছে ব্যাপক ভূমিকা। গ্রামের অপরপ্রান্তে অবস্থিত চাঁন্দামারী ফাজিল মাদ্রাসাটিও শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রযাত্রার অংশীদার। অতিথি আপ্যায়নে পান-সুপারি এ অঞ্চলের অনেক পুরনো রীতি।

গ্রামের মাঝে ইয়া বড় একটি বটগাছ ছিল! গল্পের শুরুতে কিংবা গ্রামের কোন দৃশ্যপটের বর্ণনা দিতে গিয়ে এমন বাক্য প্রায়শই ব্যবহার করা হয়। ক্ষেত্রবিশেষে এটি বটগাছ, আমগাছ কিংবা অন্যকোন গাছও হতেপারে। তবে বিভিন্ন কারণে কালের সাক্ষী বহন করে আসা প্রাচীন এই গাছ গুলো বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে সেই গ্রামীণ দৃশ্যপটের অনেকটাই পরিবর্তন ঘটছে। এই তো, বাড়ীর পাশে আমাদের চাঁন্দামারী বাজারেও বট এবং পাকুড় মিলে একজোড়া গাছ ছিল। যা কয়েকবছর আগে ঝড়ের তাণ্ডবে উপরে পরে গেছে। কথিত আছে, স্থানীয় ব্যক্তিত্ব পটল বৈরাগী ঢাক-ঢোল পিটিয়ে মহাসমারোহে এ গাছদুটির বিয়ে দিয়ে একত্রে রোপন করেছিলেন। যাই হোক, গ্রামের শেষভাগে পর পর দুটি মোড়ে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এখনো বট এবং পাকুড় বৃক্ষ টিকে আছে।

গ্রীষ্মে আম, জাম, কাঠাল, লিচুসহ হরেক রকম ফলের মৌ মৌ গন্ধ, বর্ষায় টিনের চালে ঝুম বৃষ্টি, জোৎস্না মাখা রাত, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, সন্ধ্যাবেলায় জোনাকির ছড়াছড়ি হৃদয়ে এনে দেয় অন্যরকম অনুভূতি। প্রিয় ঋতু শরতের ভোরবেলা খালি পায়ে বিন্দুবিন্দু শিশিরকণা যুক্ত সবুজ ঘাস মারিয়ে শুভ্র বাতাসে শাপলা-পদ্মের হালকা দোল খাওয়া আর ভেসে বেড়ানো সাদা তুলো তুলো মেঘেদের দল যে কাউকেই নিমিষে মাতাল করে দেয়। এমন মাতাল হওয়ার লোভে সেই ছোট্টবেলা থেকে এখন পর্যন্ত সুযোগ পেলেই ছুটে যাই আমাদের বিলের ধারের সেই নতুন রাস্তাটায়। হেমন্তে খেত ভরা ধান, হার কাঁপানো শীতে হরেক রকমের পিঠাপুলি আর বসন্তের রঙে সজ্জিত চিরায়ত প্রকৃতি যে কারোরই মনে এনে দেয় প্রশান্তি। ভাবুক হৃদয়ে দেয় দোলা, জাগায় প্রেম, কবি মনে সঞ্চারিত হয় নতুন সৃষ্টিকর্মের নির্যাস। চাঁন্দামারী গ্রামের প্রতিটি ধূলোকণায় যেন মিশে আছে আমার শৈশব কৈশোরের স্মৃতি, আমার অনুভূতি, আমার অস্তিত্ব। আমি ভালোবাসি আমার গ্রামকে, গ্রামের প্রতিটি ধূলিকণাকে।






নুসরাত জাহান : লেখক ও সংগঠক, কুড়িগ্রাম।
ইমেইল:nusrat9875jahan@gmail.com
‘আমার প্রিয় গ্রাম’ নিয়ে লিখুন
আপনি আপনার প্রিয় গ্রামকে নিয়ে আমাদের কাছে লিখুন। সঙ্গে পাঠাবেন গ্রামের একাধিক ছবি ও আপনার পরিচতি। সর্বনিম্ম ৩০০ শব্দে লিখে ফেলুন আপনার গ্রামের যা যা আছে, বেড়ে ওঠা, গ্রামকে নিয়ে স্মৃতি, স্বপ্ন, গ্রামে মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, ইতিহাস-ঐতিহ্য স্থাপনাসহ নানা বিষয়— এই সব নিয়ে চটজলদি লিখে আমাদের ইমেইল করুন। ইমেইল : boicharita@gmail.com
“অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি প্রিয় বান্ধবী”🙏🙏
এতো সুন্দর এবং সুস্পষ্ট ভাবে প্রিয় গ্রামের ঐতিহ্যে ও ইতিহাস তুলে ধরার জন্য❤️❤️আমি আশা করি,,তোমার কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে পারবো,,যে স্থানগুলোর ইতিহাস নতুন প্রজন্ম কে জানিয়ে দিবে,সেই সঙ্গে নিজ নিজ গ্রামের ইতিহাস অন্যদের কাছে তুলে ধরতে পারবে🥰🥰🥰🙏🙏❤️❤️❤️❤️❤️
ধন্যবাদ দোস্ত। দোয়া রাখিস